নিরাপদ খাদ্য নিরাপদ ভাবনা

শেয়ার করুন

॥ ড. মো. মনছুর আলম ॥

সমাজচিন্তকগণের মতে পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় শ্রেণিবৈষম্য প্রকট আকার হয়। রাষ্ট্রের বেশিরভাগ সম্পদ গুটিকয়েক মানুষের হাতে চলে যায়। ধনি-গরিবের ব্যবধান আকাশ-পাতাল হওয়ায় সর্বত্র অস্থিরতা বিরাজ করে। ফলে অধিক মুনাফালোভীর সৃষ্টি হয় বেশি। বলতে গেলে শতকরা ৯০% ভাগ মানুষ এ ব্যধিতে আক্রান্ত হয়। এ ব্যবস্থায় আমাদের মত উন্নয়নশীল দেশে চলে অসম প্রতিযোগিতা। মানুষ রাতারাতি ধনিক শ্রেণিতে পরিণত হতে চায়। ধনি হবার অসম প্রতিযোগিতায় নেমে বাংলাদেশের মানুষ নীতি-নৈতিকতা হারিয়ে কান্ডজ্ঞানহীন দিকশূন্য হয়ে পড়েছে। তারা নিত্য ব্যবহার্য পণ্যদ্রব্য তেল, ঘি, ফল-মূল, তরিতরকারি, শাক-সবজি, মাছ-মাংস এমন কি শিশুখাদ্যেও বিষ মেশাতে দ্বিধা করছে না। ফলে মানুষ দ্রুত বিভিন্ন রোগ-ব্যাধিতে পতিত হচ্ছে। প্রতিকারের আশায় ডাক্তার এবং ঔষধকেই শেষ আশ্রয় হিসেবে ভরসা করছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই ঔষধ এবং ডাক্তারের মধ্যেই বেশি ভেজাল। নিত্য ব্যবহার্য ভেজাল পণ্যদ্রব্যের মত বাংলাদেশের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মস্তিস্কে ভেজাল ঢুকে গেছে। বর্তমানে সকল উৎপাদক শ্রেণি বিশেষ করে কৃষি উৎপাদক শ্রেণি সংক্রমিত হওয়ায় ভয়ের কারণটা বেশি হয়ে দেখা দিয়েছে। কৃষকরা শাক-সবজি, তরিতরকারী উৎপাদন করতে ফসলে প্রয়োগ করছে মাত্রাতিরিক্ত কেমিক্যাল ও বালাইনাশক বিষ। তারা মুরগি ও মাছে গ্রোথ হরমন ব্যবহার করছে অবাধে। তারা অতি তারাতারি ফসল ঘরে তোলা এবং অধিক মুনাফার জন্য ফসলে প্রয়োগ করছে অধিক বর্ধনশীল বা ভিটামিন জাতীয় ঔষধ; যা ভক্ষণ করে মানুষ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হারিয়ে ফেলছে।
আমাদের নগর জীবনে অভ্যস্ত পরিবারগুলোর সাথে ডায়াবেটিসের এখন পরম আত্মীয়তা। বুক জ্বালাপোড়া উচ্চ রক্তচাপ, স্টোক হয়েছে তাদের নিত্য সাথী। আর গ্যাস ছাড়া আছে গ্রামীণ কিংবা নগর এমন মানুষ কল্পনাই করা যায় না। ভেজাল খাদ্য গ্রহণে ক্যান্সার নামক মরণব্যাধি আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। খাবার তৈরীতে অতিরিক্ত ভেজালযুক্ত তেল-মসলার ব্যবহার, পোড়া তেলের ব্যবহার, আইস ক্রিম, জুস, কোল্ড ড্রিংস, এনার্জি ড্রিংস খাওয়া, ফরমালিন যুক্ত ফল-মুল মনুষ স্বাস্থ্য ঝুকিতে ফেলে দিচ্ছে। একদিকে উৎপাদক বিষ দিয়ে উৎপাদন করছে অপরদিকে মুনাফালোভী ব্যবসায়ী নির্বিচারে ফরমালিন ও নানা প্রকারের কেমিক্যাল মিশিয়ে জাতিকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। তারা শিশু খাদ্যগুলোতেও ভেজাল, ফরমালিন নামক বিষ মেশানো হতে বিরত থাকছে না। শিশুদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, চোখের সমস্যা ও গ্যাষ্ট্রিক।
বর্তমান ফেসবুক-ডিজিটাল বাস্তবতায় আমাদের ভয়ের কারণ আরো একটি সুক্ষœাতি-সুক্ষè বিষয়ে। আর সেটা হলো মানুষের স্বপ্নগুলোতেও ভেজাল ঢুকে যাচ্ছে। মানুষ সব কিছু হারিয়ে স্বপ্ন নিয়েই বেঁচে থাকে। স্বপ্নকে পুঁজি করে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা করে। সুপ্ত অবস্থায় বিচরণ করে মনোহর মহাজগতের জতিস্ক-নক্ষত্রে। যুগে যুগে কবি-সাহিত্যিগণ মানুষকে স্বপ্ন দেখতে সাহস যুগিয়েছে। আমাদের পূর্বপুরুষগণ ফ্রেস স্বপ্ন দেখতেন, স্বপ্নের বীজ বোপন করতেন। পিতা-মাতা শিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে পূর্বপুরুষের বিজয় গাঁথা, গল্প-কবিতা শুনাতেন; জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিরত্বের কাহিনি, গল্প শুনাতেন। শিশুরাও সে অনুপাতে স্বপ্ন বুনতো; বাস্তবায়নে উদগ্রীব থাকতো। যার প্রকৃষ্ট উদাহারণ স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্ন’, ‘সোনার বাংলা’র স্বপ্ন। তার বীর সন্তানরা বাস্তবায়নে তার শ্রেষ্ঠ সম্পদ নিজের জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এখন ডিজিটাল পিতা-মাতা তার সন্তানের শিয়রে বসে ফেসবুক চালায়। মা তার সন্তানদের নিয়ে ঝগড়া-ঝাটি, হিংসাত্মক, কুরুচিপূর্ণ সিরিয়াল দেখে। অথবা শিশুদের সময় না দেয়া। এসব কারণে শিশুরা একদিকে যেমন মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে পড়েছে তেমনি বিজয়ের স্বপ্ন ভুলে আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়েছে। অদূর ভবিষ্যতে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে; সচেতন মহলকে ভাবনার উদ্রেক করে। তবে হতাশার কারণ নেই। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সমাজের জাগ্রত বিবেক- মন, মনন, চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-জ্ঞান যুগের সাথে ক্রিয়া করে চলে। বর্তমান যুগজিজ্ঞাসাকে মাথায় রেখে ভোক্তার অধিকার নিরাপদ খাদ্য নিরাপদ ভাবনা ও নিরাপদ স্বপ্নের জন্য লড়াইয়ে নেমেছে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), পাবনা শাখা- নিরাপদ খাদ্য কী? ভেজাল খাদ্য কী? ভোক্তার অধিকার কী? ফরমালিনযুক্ত ফল-মূল, মাছ-মাংস কীভাবে সনাক্ত করা যায়, কীভাবে খাদ্য নিরাপদ রাখা যায়, ছাত্র-ছাত্রীদের কাউন্সিলিং, বিভিন্ন শিক্ষামূলক প্রতিযোগিতার আয়োজন, লিফলেট বিতরণ, নিয়মিত বাজার মনিটরিং, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবস পালন, কৃষকসহ সকল উৎপাদক শ্রেণি ও অধিক মুনাফালোভীদের ভেজালে নিরুৎসাতি করা, প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে তুলে দেওয়াসহ প্রভৃতি বিষয়ে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছে।
ভোক্তা কে? প্রশ্নটা অবান্তর মনে হলেও ভোক্তা প্রকৃতপক্ষে একটি আপেক্ষিক শব্দ। কারণ যিনি ভোজন করেন তিনিও ভোক্তা আবার যারা খাদ্য উৎপাদন করেন, খাদ্যে ভেজাল (ফরমালিন, বিভিন্ন প্রকারের কেমিক্যাল) মেশান তারাও ভোক্তা। সমাজের যে অংশটি অধিক মুনাফালোভী, পরিমাপে কম দেয়, ওজনে কম দেয় তারাও কোন না কোন জায়গা হতে পণ্য ক্রয় করছেন এবং ভোগ করছেন সুতরাং তারাও ভোক্তা। ড. মুহম্মদ এনামুল হক বাংলা একাডেমির ব্যবহারিক বাংলা অভিধানে উল্লেখ করেন ভোক্তা অর্থ- ভক্ষক, যে ভোগ করে, যিনি ভোজন করেন অর্থাৎ উপভোগকারী। তিনি আরো বলেন- ‘যাঁরা শাস্তিদাতা তারাই ভোক্তা’। বর্তমান বাস্তবতায় শেষোক্ত বাক্যটি অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। কারণ উপরের আলোচনায় প্রতীয়মান হয়েছে আমরা কোন না কোনভাবে সমাজের সবাই ভোক্তা। অতএব আমরা সমাজের প্রত্যেকটি ব্যক্তিই যদি শাস্তিদাতা হয়ে যাই তাহলে এক সময় শাস্তি গ্রহীতা সার্চ লাইট দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বর্তমান অবস্থার আলোকে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) পাবনা জেলা, এই কর্ম পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রশাসনের সাথে আইনি ও গণসচেতনতামূলক- উভয়বিদ কার্যক্রম নিষ্ঠার সাথে পরিচালনা করে যাচ্ছে।
বিশ^ ভোক্তা অধিকার দিবস সাধারণত ১৫ মার্চকে উপজীব্য করে আন্তর্জাতিকভাবে উদযাপিত দিবস। ১৯৬২ সালে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি কংগ্রেসে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষার বিষয়ে অর্থাৎ নিরাপত্তার অধিকার, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার, পছন্দের অধিকার এবং অভিাযোগ প্রদানের অধিকার- এই ০৪ (চারটি) মৌলিক অধিকার তুলে ধরেন। এটাই পরবর্তীকালে ভোক্তা অধিকার আইন নামে পরিচিতি লাভ করে। ১৯৮৫ সালে জাতিসংঘের মাধ্যমে ভোক্তা অধিকার রক্ষার নীতিমালায় কেনেডি বর্ণিত আরো বিস্তৃত করে অতিরিক্ত আরো ০৮ (আটটি) মৌলিক অধিকার সংযুক্ত করে এর পরিধি বাড়ানো হয়। জাতিসংঘ স্বীকৃত এই ভোক্তা অধিকার ০৮টি হলো- ১. খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বিনোদনের মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার; ২. ন্যায্য মূল্যে সঠিক পণ্য ও সেবা পাওয়ার অধিকার; ৩. পণ্যের উৎপাদন, ব্যবহার বিধি, পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি তথ্য জানার অধিকার; ৪. যাচাই-বাছাই করে ন্যায্যমূল্যে সঠিক পণ্য ও সেবা পাবার অধিকার; ৫. কোন পণ্য বা সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্থ হলে ক্ষতিপূরণ পাওয়ার অধিকার; ৬. অভিযোগ করার ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার;.৭. ক্রেতা-ভোক্তা হিসেবে অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষালাভের অধিকার এবং ৮. স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ ও বসবাস করার অধিকার।
কেনেডি ভাষণের দিনকে স্মরণীয় করে রাখতে ১৫ মার্চকে বিশ^ ভোক্তা অধিকার দিবস হিসেবে বৈশি^কভাবে উদযাপন করে আসছে। বাংলাদেশ ১৯৮৫ সাল থেকে দিবসটি যথাযথ মর্যাদার সাথে পালন করে আসছে। একজন ভোক্তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে- ১. পণ্য বা সেবার মান ও গুণাগুণ সম্পর্কে সচেতন বা জিজ্ঞাসু হোন; ২. ভোক্তা হিসেবে অধিকার সংরক্ষণে সোচ্চার ও সংগঠিত হোন; ৩. আপনার আচরণে অন্য ক্রেতা যেন ক্ষতিগ্রস্থ না হোন সে ব্যাপারে সচেতন থাকুন; ৪. পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সচেতন ও সক্রিয় হোন; ৫. ভোক্তা-অধিকার লঙ্ঘনজনিত অভিযোগ দায়ের করুন।
আমরা অনেকে ফ্রিজে খাবার রেখে খাওয়াকে নিরাপদ মনে করি। বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন দীর্ঘদিন ফ্রিজে কাঁচা মাছ-মাংস রেখে খাওয়া যেমন নিরাপদ নয় তেমনি অল্প সময়ের জন্য হলেও খাবার যথাযথভাবে ঢেকে না রেখে খাওয়াও নিরাপদ নয়। কারণ ফ্রিজে এক খাবার থেকে অন্য খাবারে অতি সহজেই ব্যাকটেরিয়া মিশে খাবারকে দূষিত করে। আমাদের অনেকেই ফ্রিজে পানি, দুধ ও জুস রেখে ঠা-া করে খেতে পছন্দ করি। কিন্তু এটাও উচিত নয় এতে ঠা-াজনিত বিভিন্ন রোগ হতে পারে, এছাড়া পরিপাক ক্রিয়ায় ব্যাঘাত ঘটে।
নিরাপদ খাদ্য ভোক্তার মৌলিক অধিকার। আমাদের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য নিরাপদ খাদ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। নিরাপদ খাদ্য বা ভেজালমুক্ত খাদ্য নিশ্চিতকরণে খাদ্য উৎপাদন-বিপণন, আমদানী, প্রক্রিয়াজাতকরণ, সরবরাহ, মজুদ, বিক্রয় প্রভৃতি কার্যক্রম বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির অনুশীলন ও সমন্বয় সাধন করাও সরকারের দায়িত্ব। বর্তমান সরকার নিরাপদ খাদ্য আইন- ২০১৩, ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন- ২০০৯, প্রণয়ন করেছে এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ করারও চেষ্ঠা করছে। আমরা সকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। ভেজালমুক্ত খাদ্য ও ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব), পাবনা জেলা নব-গঠিত কমিটি পাবনার নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করে আরো বৃহত্তর পরিসরে এগিয়ে যাবে; এ আশা করতেই পারি। [লেখক : সাংগঠনিক সম্পাদক, কনজুমার অ্যাসোসিয়েশান অব বাংলাদেশ (ক্যাব), পাবনা।]


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *