পাবনায় লক্ষ্য মাত্রায় চেয়ে বিপুল পরিমানে মাছ উৎপাদন

শেয়ার করুন

মামুন হোসেন (পাবনা) : বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এ দেশ জুড়ে রয়েছে অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিল, হাওর-বাওড় ও পুকুর। পরিবেশগত ও প্রাকৃতিক কারণে এ দেশে মৎস্য উৎপাদনে বিস্তৃত ক্ষেত রয়েছে। এদেশের আবহাওয়া জলবায়ু, মাটি ও পানি মৎস্য চাষের উপযুক্ত হওয়ায় প্রচুর পরিমাণে মাছ উৎপাদন করা যায়। কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে আর্থসামাজিক উন্নয়নে মৎস্য খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, দারিদ্র্যবিমোচন ও প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি দূরীকরণে মৎস্য খাতের ভূমিকা অপরিসীম। দেশে মাছ চাষ করে নিজেদের ভাগ্যবদল করেছেন অনেক মাছ চাষী তবে পিছিয়ে নেই পাবনার চাষীরাও। বর্তমান সরকারের সময়োপযোগী পরিকল্পনা ও বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের ফলে পাবনা মৎস্য উৎপাদনে সাফল্য অর্জন করেছে।
রুপকল্প ২০২১ লক্ষ্যকে সামনে রেখে মৎস্য ও প্রাণীসম্পদ মন্ত্রাণালয়ের অধীনে মৎস্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন হয়েছে যেমন, ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্যচাষ প্রযুক্তি সেবা সম্প্রসারণ প্রকল্প, জাতীয় কৃষি প্রযুক্তি প্রকল্প (কর্মসূচি-২) মৎস্য অধিদপ্তর অংগ, জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্প, ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প ও রাজশাহী বিভাগ মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প । এসব প্রকল্প পাবনা জেলায় বাস্তবায়িত হওয়ায় পাবনায় মৎস্য চাষ ও উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। এছাড়া ২০১৯ ও ২০২০ সালে মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে বিশেষ কার্যক্রম বাস্তবায়নের ফলে পাবনা মৎস্য খাত ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে।
পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ এর দেওয়া তথ্য মতে, পাবনা মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধ একটি জেলা। এ জেলার ৯টি উপজেলায় বদ্ধ জলাশয় পুকুরদীঘী, বরোপিট, কোল মাছচাষ উপযোগী ধান ক্ষেতসহ সব মিলে ১২,৬৪০ হেক্টর বদ্ধ জলাশয় রয়েছে। খাল, বিল, নদ, নদী প্লাবনভূমিসহ মুক্ত জলাশয় রয়েছে ৪০,৫৭৫ হেক্টর। এছাড়াও বর্তমানে পাবনায় খাঁচায় মাছচাষ কার্যক্রম মৎস্য উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির নতুন দিগন্ত ও আশার আলোর সঞ্চার করেছে। পাবনা জেলার দক্ষিণে রয়েছে বাংলাদেশের প্রধান প্রমত্তা নদী পদ্মা এবং পূর্বে রয়েছে যমুনা। এছাড়াও এ জেলার মধ্য দিয়ে প্রভাবিত হয়েছে ইছামতি ও বড়ালের মত ছোট ছোট নদী। এজেলায় রয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ চলনবিলের বিস্তৃতি। এসব নদী ও খাল বিলের দেশীয় প্রজাতির মাছের চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে ।
পাবনা জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য সুত্রে জানাযায়, ২০২১-২০২২ সালে পাবনা জেলায় মাছের উৎপাদন হয়েছে ৬৯,৫৬৪ মে.টন, জেলায় মাছের চাহিদা রয়েছে ৫১,৭৩২ মে.টন, চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হয়েছে ১৭,৮৩২ মে.টন। ২০২২-২০২৩ সালে মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৭১,৪৫০ মে.টন।
মৎস্য সম্পদ উন্নয়নে সরকারের গৃহীত প্রকল্প মাঠ পর্যায়ে উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে খামারীদের মৎস্য খামারগুলোকে আধুনিকী ও যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ করেছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় মাঠ পর্যায়ে মৎস্য খামারীদের হাতে কলমে মাছচাষ ও স্বাস্থ্যসম্মত মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি শেখানো ও আধুনিক প্রযুক্তি বিস্তারের লক্ষ্যে চাষীদের পুকুরে প্রদর্শনী খামার স্থাপন করা হয়েছে। প্রদর্শনী এলাকার চাষিদের দলবদ্ধ করে প্রশিক্ষণ প্রদান, প্রদর্শনী পুকুর পাড়ে চাষীদের নিয়ে উঠোন বৈঠক এবং প্রদর্শনী পুকুরের মাছ নমূনায়ন করে ফলাফল প্রদর্শনের মাধ্যমে চাষীদের মাছচাষ বিষয়ে খুটিনাটি বিষয় শিখানো এবং চুড়ান্ত আহরণকালে মাঠ দিবস উদযাপনের মাধ্যমে প্রদর্শনীর ফলাফল এলাকার মাছ চাষী, গণ্যমাণ্য ব্যাক্তিবর্গ, ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, মেম্বার, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ অন্যান্য কর্মকর্তাবৃন্দকে প্রদর্শন ও অবহিত করা হয়েছে। এসকল কর্মকান্ডের ফলে প্রত্যেক গ্রামের মাছ চাষীরা আধুনিক ও অধিক উৎপাদনশীল প্রযুক্তির চাষ পদ্ধতি আয়ত্ব করে এখন মাছ চাষ করছে। এর ফলে পূর্বে প্রচলিত কার্প জাতীয় মাছ চাষের পাশাপাশি পাবদা-গুলশা, শিং-মাগুর, শোল-গলদা কার্প মিশ্রচাষসহ খাঁচায় মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ ব্যাপক আকারে সম্প্রসারিত হয়েছে। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে একদিকে যেমন মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে অন্যদিকে বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করছে, এতে করে দেশিয় মাছ চাষে খুলছে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার।
পাশাপাশি মুক্ত জলাশয়ের মাছের বংশ সংরক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে পাবনা মৎস্য অধিদপ্তর মাছের আবাসস্থল উন্নয়ন, অভয়াশ্রম স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণ, বিল নার্সারী স্থাপন, মুক্ত জলাশয়ে মাছের পোনা অবমুক্তকরণ, মৎস্য সংরক্ষণ, আইন বাস্তবায়ন, বিকল্প কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে জেলেদের ছাগল, ভ্যান, সেলাই মেশিন বিতরণ, মৎস্য বান্ধব জাল প্রদান, ইলিশ জেলেদের ভিজিএফ প্রদানসহ মৎস্য সংরক্ষণে জেলে পল্লীতে আলোচনা ও সচেতনকরণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে।
একই সাথে গুণগত মাছের রেনু পোনা চাষীদের প্রদানের লক্ষ্যে তিনটি সরকারী মৎস্যবীজ উৎপাদন খামারে শুদ্ধ জাতের মা ও বাবা মাছের প্রজননের মাধ্যমে রেনু পোনা উৎপাদন ও চাষীর নিকট সরবরাহের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে। একই সাথে বেসরকারি মৎস্য বীজ উৎপাদন খামারে গুণগত মানসম্পন্ন রেনু পোনা উৎপাদন নিশ্চিতকরণে মৎস্য হ্যাচারী আইন, ২০১০ ও মৎস্য হ্যাচারী বিধিমালা, ২০১১ এর বিধানবলী সাপেক্ষে হ্যাচারী লাইসেন্স প্রদান ও নবায়নের কাজ করছে। এবং হ্যাচারী উদ্যোগক্তাদের বিশুদ্ধ জাতের রেনু পোনা উৎপাদনে কারীগরী বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। সেই সাথে নিয়মিত পর্রিদর্শন, অভিযান ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে আইনের প্রয়োগ কার্যকর রেখেছে। মৎস্য চাষীদের উপযুক্ত গুণগতমানের মৎস্য খাদ্য প্রাপ্তি নিশ্চিতকরতে মৎস্য খাদ্য উৎপাদন, আমদানি রপ্তানি, পাইকারী ও খুচরা পর্যায়ে বিপননে লাইসেন্স প্রদান ও বাৎসরিক ভিত্তিতে নবায়ন কার্যক্রম পরিচালনা করছে। বাজারে মৎস্য খাদ্যের গুনগতমান যাচাইয়ে দৈব চয়নের ভিত্তিতে নমুনা খাদ্য সংগ্রহ করে এ্যাক্রিডিটেটেড ল্যাবরেটরীতে মান পরীক্ষা করা হচ্ছে।
বর্তমানে পাবনা জেলা ইউনিয়ন পর্যায়ে মৎস্যচাষ প্রযুক্তিসেবা সম্প্রসারণ প্রকল্পের মাধ্যমে সাফল্য অর্জন করেছে, পাবনা জেলায় বিগত ৫ বছরে ইউনিয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে ১২.০৩ হেক্টর আয়তনে ৬৭ টি পুকুরে ৬৭ টি কার্প নার্সারী প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করে ২৬.৫৫ লাখ পোনা মাছ উৎপাদন করা হয়েছে। প্রদর্শনী বাস্তবায়নের পূর্বে এসব চাষীদের পুকুরে গড় বেজ লাইন উৎপাদন ছিল হেক্টর প্রতি ১.৩ লাখ পোনা। প্রদর্শনী বাস্তবায়নের ফলে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি নার্সারী সংশ্লিষ্ট এলাকার চাষীরা পোনা মাছের কৌশল আয়ত্ব করে কম ব্যয়ে কাঙ্খিত ফলাফল অর্জন করেছে।
মাছ চাষের ক্ষেত্রে মাছ চাষীদের নিকট সবচেয়ে ভারসাম্যপূর্ণ, নির্ভরযোগ্য ও জনপ্রিয় চাষ প্রযুক্তি হলো কার্প মিশ্রচাষ প্রযুক্তি। এই প্রযুক্তি বিস্তারে পাবনা জেলায় বিগত ৫ বছরে ৮.৯১ হেক্টর আয়তনের জলাশয়ে ৫৫ টি প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করে ৪৯.৩৬ মে.টন মাছ উৎপাদন করা হয়েছে। সাধারণত চাষীদের পুকুরে হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ৩.৫-৪.০ মে.টন।
বাংলাদেশের স্বাদুপানিতে প্রাপ্ত সবোর্চ্চ আকারের চিংড়ি প্রজাতি হলো গলদা চিংড়ি। মুক্ত জলাশয়ে ক্রমহ্রাসমান এসব গলদা চিংড়ি ভোক্তার নিকট সহজলভ্য করার জন্য মানসে ইউনিয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে পাবনা জেলার বিগত ৫ বছরে ৩.৪৪ হেক্টর জলাশয়ে ২৩ টি প্রদর্শনী স্থাপন করে ৬.০ মে.টন চিংড়ি ও ১০.০ মে.টন কার্প জাতীয় মাছ উৎপাদন করা হয়েছে। বর্তমানে চিংড়ি উৎপাদনে সফলতা চাষীদের চিংড়ি চাষে উদ্বুদ্ধ করেছে।
পাঙ্গাস স্বল্প মূল্যের সহজলভ্য মাছ হওয়ায় নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ক্রেতার নিকট এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ মাছ । ময়মনসিংহ জেলায় পাঙ্গাস মাছ ব্যাপক আকারে চাষ হয়ে থাকে। অধিক উৎপাদনশীল এ মাছের চাষ পদ্ধতি সম্প্রসারণে পাবনা জেলায় বিগত ৫ বছরে ২০.১১ হেক্টর জলাশয়ে ৩১ টি প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করে ৯১.০ মে.টন পাঙ্গাস উৎপাদন করা হয়েছে।
ধানক্ষেতে মাছ চাষ প্রযুক্তি এ প্রযুক্তি বেশ জনপ্রিয় না হলেও পাবনা জেলায় খাল, বিল ও নিচু জমি থাকায় বোরো ধান কাটার পর অনেক জমি জলাবদ্ধ অবস্থায় পতিত থাকে। এ জমিকে মাছ চাষের আওতায় এনে উৎপাদনশীল করার লক্ষে বিগত ৫ বছরে পাবনা জেলায় ৩.৮ হেক্টর জমিতে ১৫ টি ধানক্ষেতে মাছ চাষ প্রযুক্তি প্রদর্শনী স্থাপন করে ১৮.০ মে.টন মাছ উৎপাদিত হয়েছে।
শিং মাগুর জিওল মাছ হিসেবে পরিচিত, সুস্বাদু ও বাজার মূল্য অধিক এ মাছ আধুনিক পদ্ধতিতে চাষ করায় বর্তমানে পাবনায় এ মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। রোগীর পণ্য হিসেবে পরিচিত এ মাছের ১৪.৫৬ হেক্টর জলাশয়ে ৪৮টি প্রদর্শনী বাস্তবায়ন করে ৯৫.০ মে.টন শিং মাগুর উৎপাদন করা হয়েছে।
মনোসেক্স তেলাপিয়া গ্লোবাল বা বৈশ্বিক পরিমন্ডলের গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃত একটি মাছ। মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ অধিক উৎপাদন হয়ে থাকে এবং এ মাছ যেকোন প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকতে সক্ষম। বিগত ৫ বছরে পাবনা জেলায় ১৪.৯২ হেক্টর জলাশয়ে ৫২ টি মনোসেক্স তেলাপিয়া প্রদর্শনী স্থাপন করে ১৭০ মে.টন তেলাপিয়া উৎপাদিত হয়েছে।
এছাড়া ইউনিয়ন প্রকল্পের অর্থায়নে বিগত ৫ বছরে ২০টি সিবিজি দল গঠন করে দলীয়ভাবে মাছ চাষ করছে। প্রতি দলে ১৭ জন মাছ চাষী ও ০৩ জন লিফ নিয়ে গঠিত দলে প্রকল্প সহায়তা প্রদান করা হয়েছে। ৭টি দল কার্প মিশ্রচাষ ও ১৩টি দল খাঁচায় মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছ চাষ করছে। কার্প মিশ্রন চাষের পুকুরে ৫টি এ্যারেটর স্থাপন করা হয়েছে। ইউনিয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে বিগত ৫ বছরে ১১২ ব্যাচে ১৫৮৭ জন (্এর মধ্যে ২০৬ জন নারী) মাছ চাষীকে মাছ চাষের আধুনিক কলাকৌশল ও লাভজনক চাষ প্রযুক্তি বিষয়ে দুই ধাপে ৪ দিন মেয়াদী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। প্রশিক্ষিত চাষীরা প্রশিক্ষণে অর্জিত জ্ঞান, দক্ষতা প্রয়োগ করে নিজেদের পুকুরে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধিতে সক্ষম হয়েছে।
প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির বা বাস্তব প্রমাণ প্রদর্শনের নিমিত্ত প্রদর্শনীর মাছ আহরণকালে প্রদর্শক চাষীর পুকুর পাড়ে ২৫টি মাঠ দিবস উদযাপনের মাধ্যমে ৮৫৪ জন চাষীকে ফলাফল প্রদর্শন করা হয়েছে। ৭৫৩ জন চাষী প্রযুক্তি নিজেদের পুকুরে প্রয়োগের মাধ্যমে অধিক উৎপাদনে মনোনিবেশ করেছেন। ইউনিয়ন প্রকল্পে প্রতি ইউনিয়নে একজন করে ৭৪ জন মাছ চাষীকে স্থানীয় মৎস্য সম্প্রসারণ প্রতিনিধি (লিফ) দায়িত্ব দিয়ে চাষীদের দোরগোড়ায় মৎস্য চাষ সেবা পৌছানোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব লিফ বিগত ৫ বছরে ১১,৪৩৩ টি পুকুর পরিদর্শন করেছেন এবং ১৪,০৪৭ জন চাষীকে পর্রামর্শ দিয়ে চাষীদের সমস্যার সমাধান দিয়েছে। বর্তমানে লিফদের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ১,৬৯১ জন মাছ চাষী মাছ চাষের আধুনিক প্রযুক্তি অনুসরণ কওে বর্তমানে অধিক মাছ উৎপাদন করছেন।
প্রযুক্তির বিস্তারে ইউনিয়ন পরিষদের জনপ্রতিনিধি ও মাছ চাষিদের নিয়ে এ পযর্ন্ত ৭০ টি মতবিনিময় সভা করা হয়েছে। এসব সভায় ১৯৯ জন পুরুষ ও ৬৭ জন মহিলা জনপ্রতিনিধি এবং ২,৪৮৯ জন মাছ চাষী অংশগ্রহণ করে মাছ চাষের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করেছেন।
পাবনা মৎস্য অধিদপ্তর এর দেয়া তথ্য মতে, এনএটিপি-২ প্রকল্পের আওতায় পাবনা জেলায় ১২০টি সাধারণ সুফলভোগী দল নিয়ে (কমন ইন্টারেস্ট গ্রুপ সিআইজি) গঠন করা হয়েছে। প্রতি দলে ২০ জন করে মাছ চাষী রয়েছে, এর মধ্যে নারী রয়েছে ৩৫% । দলগুলো সমবায় সমিতি হিসেবে নিবন্ধনধারী। এসব দলের সদস্যদের পুকুরে বিগত ৫ বছরে ২১ টি কার্প নার্সারী, ৬৬৬ টি কার্প মিশ্র, ৭টি পাঙ্গাস, ১ টি হোয়াইট পাঙ্গাস, ৬৪ টি পাবদা গুলশা, ৩৫ টি শিং মাগুর, ২৪ টি মনোসেক্স তেলাপিয়া প্রদর্শনী স্থাপন করে সিআইজি সদস্য ও পার্শ্ববর্তী চাষীদের মাছ চাষের আধুনিক কলাকৌশল হাতে কলমে শেখানো হয়েছে।
এসব প্রদর্শনীর ফলাফল সিআইজি ও সিআইজি বহিভূর্ত মাছ চাষীদের নিয়ে ৬৩০ টি মাঠ দিবস আয়োজনের মাধ্যমে অবহিত করা হয়েছে। এনএটিপি-২ প্রকল্পে সিআইজি ও সিআইজি বহির্ভূত চাষদের পুকুর পরিদর্শন, পরামর্শ প্রদান ও মাছ চাষ প্রযুক্তি সম্প্রসারণে লক্ষ্যে ৬০ জন স্থানীয় সম্প্রসারণ প্রতিনিধি (লিফ) দাশিত্বপ্রাপ্ত। এক্ষেত্রে ০৯ জন নারী লিফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বিগত ৫ বছরে লিফগণ ৮,২৮০ টি পুকুর পরিদর্শন করে পুকুরের পানির পিএইচ, অক্সিজেন, অ্যালকালিনিটি পরিমাপ করে ১৬,১০১ জন মাছ চাষীকে মাছ চাষ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। এসব কর্মকান্ডের ফলে ২,৬০৯ জন মাছ চাষী প্রযুক্তি অনুসরণে মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ হয়েছে। এনএটিপি-২ প্রকল্পের আওতায় ৪৮৫ ব্যাচে ১০,৩৪৮ জন পুরুষ ও ৩,৮৪৭ জন নারীকে মাছ চাষের মৌলিক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।
এছাড়া এআইএফ-২ ফান্ডের আওতায় ১৭টি মাছ চাষের উপকরণ পরিবহনে পিকআপ ভ্যান, ১৩টি এ্যারেটর, ৮টি ক্ষুদ্র মৎস্য খাদ্য পিলেটিং মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। এআইএফ-৩ ফান্ডের আওতায় ১টি পিকআপ ভ্যান, ১টি ক্ষুদ্র মৎস্য খাদ্য পিলেটিং মেশিন বিতরণ করা হয়েছে। এনএটিপি-২ প্রকল্পের আওতায় সাধারণ সুফলভোগীদের নিকট এআইএফ-২ তহবিলের অর্থায়নে সেচ পাম্প, ক্ষুদ্র মৎস্য খাদ্য কারখানা, মাছ ধরা জাল, মাছ পরিবহনে পিক আপ ভ্যান বিতরণ করা হয়েছে। চাষী দল তহবিলের ৩০% অর্থ ও প্রকল্পের ৭০% ম্যাচিং গ্রান্টের সহায়তায় এসব সুবিধা গ্রহণ করে দলীয়ভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে। একইভাবে প্রকল্প এলাকার আগ্রহী উদ্যোক্তা এগ্রিকালচারাল ইনোভেশন ফান্ড-৩ এর আওতায় নিজিস্ব ৩০% ও এনএটিপি-২ প্রকল্পের ম্যাচিং গ্রান্টের ৭০% অর্থের মাধ্যমে খামার যান্ত্রীকীকরণে এ্যারেটর, স্মার্ট ফিডার, সেচ পাম্প, মাছ প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে মৎস্য ক্ষেত্রে বৈচিত্রময় পেশা ও মৎস্য পণ্যের সমাহার ঘটিয়েছে। বর্তমানে পাবনায় মাছ চাষের পুকুরে মুক্তা চাষ করে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচোন করেছে। এসব প্রকল্পের বিল ব্যবস্থাপনা কম্পোনেন্টের আওতায় ১০ টি বিল নার্সারী, ৩ টি মৎস্য অভয়াশ্রম স্থাপন করা হয়েছে। এসব বিলের মাছ আহরণ করে বিল সংলগ্ন ১,৫৭২ জন চাষী সুফল ভোগ করছেন।
রাজশাহী বিভাগে মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় পাবনা জেলায় ০২ টি কার্প মিশ্রচাষ প্রদর্শনী, ০৭ টি কার্প গলদা প্রদর্শনী, ৫টি কার্প পাঙ্গাস প্রদর্শনী, ১৯ টি উন্নত প্রযুক্তির মাছ চাষ প্রদর্শনী, ১৪টি পাবদা-গুলশা চাষ প্রদর্শনী, ১০ টি শিং-মাগুর চাষ প্রদর্শনী, ১০ টি মনোসেক্স তেলাপিয়া চাষ প্রদর্শনী, ০২ টি কুচিয়া চাষ প্রদর্শনী, ০৬ টি খাঁচায় মাছ চাষ প্রদর্শনী স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া রাজশাহী প্রকল্পের আওতায় ৮৮ ব্যাচে ১,৯১৫ জন পুরুষ ও ৩৩৫ জন নারী মাছচাষীকে ২ দিন ব্যাপী প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ৫৪৩ জন জেলেকে ১,০৪৬ টি ছাগল, ভ্যান, সেলাই মেশিন বিতরণ করা হয়েছে।
পাবনায় জলাশয় সংস্কারের মাধ্যমে মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় বিগত ৫ বছরে পাবনা জেলায় ৫০.০ হেক্টর আয়তনের ৬২ টি খাস জলাশয় পুন:খননের মাধ্যমে মাছ চাষের উপযোগী করা হয়েছে। এর ফলে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি খাস জলাশয়ের ইজারা মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে সরকারের রাজস্ব আয় বেড়েছে। উন্নয়নকৃত জলাশয়ের পাড়ে ৩৫২ টি কলা, ১,৪৭৫ টি পেপে, ৩১৫ টি পেয়ারা, ৭৯৫ টি লেবু চারা রোপণ করা হয়েছে। এছাড়া সংস্কারকৃত ২১ টি জলাশয়ে প্রদর্শনী খামার স্থাপন করা হয়েছে। এসকল খনন কার্যক্রমের ফলে ১,৭০৫ জন সুফলভোগী প্রকল্পের সুবিধা ভোগ করছে।
এছাড়া পাবনা জেলার দক্ষিণ পাশে পদ্মা নদী ও পূর্ব প্রান্তে যমুনা নদীতে মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযানের সময় মা ইলিশ বঙ্গোপসাগর হতে পরিব্রাজন করে এসে ডিম ছাড়ে। এসব ডিম ফুটে জাটকায় রুপান্তরিত হয়। মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণে পাবনা জেলায় মৎস্য অধিদপ্তরের ইলিশ সম্পদ উন্নয়ন ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এই প্রকল্পের অর্থায়নে ০৯ টি সচেতনতা সভা করে ৮৪৫ জন জেলেকে মা ইলিশ ও জাটকা সংরক্ষণের বিষয় সচেতন করা হয়েছে।
এবিষয়ে পাবনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ বলেন, বর্তমানে আধুনিক উৎপাদনশীল প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে পাবনায় মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে, এতে করে বাজারে মাছের আমদানি বেশি হওয়ায় ক্রেতারা সহজেই পছন্দের মাছ সাশ্রয়ী মূল্যে ক্রয় করতে সক্ষম হচ্ছে। তিনি বলেন, স্বল্প জনবল ও অপ্রতুল লজিস্টিকের সবোর্চ্চ ব্যবহার করে বিগত ৫ বছরে পাবনা জেলা মৎস্যখাত কাঙ্খিত সাফল্য অর্জন করেছে।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *