মামুন হোসেন, পাবনা : স্বাভাবিক মানুষের বাইরে যে সকল মানুষদের শারীরিক ও মানসিক সমস্যার কারণে জীবনের স্বাভাবিক গতি বাধাগ্রস্থ তাদের বলা হয় বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ মানুষ। এদের মধ্যে কেউ হয়তো দৃষ্টিশক্তিহীন, কেউ বা শ্রবণ কিংবা বাকশক্তিহীন, কেউ কোন একটি বিশেষ অঙ্গহীন অথবা অন্য কোন শারীরিক অক্ষমতার শিকার, আবার কেউ কেউ মানসিকভাবে অক্ষম। এরাই হলেন সমাজের বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ মানুষ। এই সকল মানুষ জন্মগত অথবা কোন দুর্ঘটনার কারণবশত হতে পারে। এদের সকলেরই পৃথিবীতে সুস্থ স্বাভাবিক ভাবে বেঁচে থাকার জন্য অপর মানুষের সাহায্যর প্রয়োজন হয়। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সরকার ছাড়াও বিভিন্ন বেসরকারি অলাভজনক সংস্থা বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ মানুষের ভাগ্যউন্নয়নে প্রতিনিয়ত কাজ করে চলছে। এই সকল সংস্থাগুলি লেখাপড়াসহ বিভিন্ন সৃজনশীলমূলক কর্মকান্ডের সাহায্যে বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ মানুষদের আপন সুপ্ত প্রতিভাকে আবিস্কার করতে সাহায্য ও উৎসাহিত করছে। এইসকল মানুষেরা একদিকে যেমন কিছুটা হলেও আত্মনির্ভর জীবনযাপনে সক্ষম হচ্ছে অন্যদিকে সমাজের বৃহত্তর ক্ষেত্রেও তারা বিশেষ অবদান রাখছে।
দেশে সরকারের পাশাপাশি অলাভজনক অনেক সংগঠন বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ মানুষের ভাগ্যউন্নয়নে কাজ করছে তেমনি একটি সংগঠন লারনার্স অর্গানাইজেশন ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই সংগঠনটি ১৫ বছর যাবত বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ মানুষের ভাগ্যউন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। লারনার্স অর্গানাইজেশন সমাজের দুঃস্থ দরিদ্র ও নিপীড়িত মানুষের সেবার জন্য প্রতিষ্ঠিত একটি প্রতিষ্ঠান। সংগঠনটি সমাজের অবহেলিত বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ ও অটিস্টিক শিশুদের নিয়ে সূচনা লগ্ন থেকেই শিক্ষা ও সেবা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এই কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ শিশুদের মানুষিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন, প্রতিভা বিকাশের সুযোগ সৃষ্টি, বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান, সামাজিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের সুযোগ সৃষ্টি এবং অটিস্টিক শিশুদের প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন সাধণের মত দূরহ কর্মসূচি পরিচালনা করে আসছে। সমাজের অবহেলিত ও সুবিধাবঞ্চিত ও অটিস্টিক শিশু কিশোরের নিরুক্ষরতা দূরীকরণসহ সম্ভাবনার দিকগুলো চিহ্নিত করে তাদের প্রতিভা বিকাশের সৃষ্টি মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বিকশিত জীবনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও লারনার্স অর্গানাইজেশন আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষার পাশাপাশি বিভিন্ন প্রকার কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিচালনার মাধ্যমে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলা এবং বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ শিশুদের নৈতিক অবক্ষয় হতে রক্ষা করা ছাড়াও উন্নত দেশগুলোর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ উন্নয়নের প্রচেষ্টা চালানো তাদের একমাত্র লক্ষ ও উদ্দেশ্য। লারনার্স অর্গানাইজেশন দরিদ্র অসহায় রোগীদের সুচিকিৎসার বিষয়ে প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা প্রদান এবং বিভিন্ন প্রকার চিকিৎসা সেবা কে›ন্দ্র পরিচালনা করছে। এছাড়াও লারনার্স অর্গানাইজেশন দরিদ্র অসহায়দের বিভিন্ন প্রকার সাহায্য সহযোগিতা ও বাসস্থানের ব্যবস্থা করাসহ বিভিন্ন প্রকার আইনী সহায়তা প্রদান করে আসছে। এছাড়াও তারা বয়স্ক বৃদ্ধদের উন্নয়নে পূর্ণবাসন মূলক বিভিন্ন প্রকার প্রকল্প গ্রহণ করছে। বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ শিশুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে। লারনার্স অর্গানাইজেশন এসব শিশুদের জন্য বিশেষ সুবিধা স্থাপন করে বিশেষ পদ্ধতিতে শিক্ষাদান করে আসছে। লারনার্স অর্গানাইজেশন এর উদ্যোগে ২০১১ সালে পাবনা জেলার বেড়া উপজেলায় বেড়া পৌরসভায় সানিলাতে লারনার্স প্রতিবন্ধী অটিজম স্কুল নামের একটি স্কুল স্থাপন করে। এই স্কুলে বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ ছাত্রছাত্রীদের নিয়মিত শিক্ষা দান করানো হয়ে থাকে। জেলার দূরদূরান্তের বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ শিশুদের জন্য নিকটবর্তী স্থানে শিক্ষা কেন্দ্র স্থাপন করে ১২ টি কেন্দ্রে তাদের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেছে। প্রথম দিকে মাত্র ১৫ জন বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ শিশুদের নিয়ে এই শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করলেও বর্তমানে ১৬১ জন বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ শিক্ষার্থীরা এই স্কুলে শিক্ষা গ্রহণ করছে। লারনার্স অর্গানাইজেশনের তত্ত্বাবাধানে শিশু কিশোরসহ সবধরণের বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ মানুষদের অভিজ্ঞ ডাক্তারদের সমন্বয়ে গঠিত একটি বিশেষায়িত মেডিকেল টিমের মাধ্যমে স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা দান করছে। মেডিকেল টিমটি ২০১১ সাল থেকে নিরলসভাবে পাবনা জেলার বেড়া, সাঁথিয়া, আটঘরিয়া ও পাবনা সদর উপজেলায় এবং ইউনিয়নে তাদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও জটিল বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ শিশুদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রানালয়ের আওতায় জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন কর্তৃক পরিচালিত প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র নিয়ে গিয়ে স্বাস্থ্য সেবা (থেরাপী) নিশ্চিত করছে। এছাড়াও শিশু কিশোরদের উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করতে লারনার্স অর্গানাইজেশন সেলাই প্রশিক্ষণ হাঁস, মুরগী পালন, কুটির শিল্পের কাজ, মৎস্য চাষ, গাভীপালন ও বনায়ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ শিশুদের পরিবারের সচেতনতার অভাবে তাদের জন্য সরকার কর্তৃক পরিচালিত বিভিন্ন সেবা ও সাহায্য কর্মসূচী থেকে বঞ্চিত হয়ে থাকে তারা। লারনার্স অর্গানাইজেশন সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে যোগাযোগ করে ও বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ শিশু কিশোরদের পরিবারকে সচেতন করে সরকারি বিভিন্ন সাহায্য ও সেবা সমূহ নিশ্চিত করতে সহায়তা প্রদান করছে। দুঃস্থ দরিদ্র অটিস্টিক শিশু ও তাদের পরিবারকে লারনার্স অর্গানাইজেশনের সহযোগিতায় বিভিন্ন সময়ে বস্ত্র ও শীত বস্ত্র বিতরণ এবং বন্যা দূরগত এলাকায় খাদ্য বিতরণ ও আর্থিক সাহায্য করে আসছে। তাদের পরিবারের গোরামি কুসংস্কার ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ শিশু কিশোররা বিভিন্ন সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকে। লারনার্স অর্গানাইজেশন উঠান বৈঠক করে কাউন্সিলিং এর মাধ্যমে সমাজে বিভিন্ন মতের মানুষের মধ্যে সামাজিক সচেতনা বৃদ্ধি ও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের লক্ষে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়াও লারনার্স অর্গানাইজেশন শিশু কিশোরদের সুরক্ষার জন্য সেফ হোম, স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ শিশুদের পরিবারের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী বিপণনের জন্য একটি পৃথক বাজার, বয়স্ক বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ মানুষের জন্য বৃদ্ধাশ্রম এবং তাদের সুরক্ষার জন্য আবাসিক হোম নির্মাণের কাজ হাতে নিয়েছে।
বর্তমানে আর্থিক সংকটের কারণে অর্গানাইজেশনটি কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হচ্ছে। একটি পুনাঙ্গ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপনের জন্য কর্তৃপক্ষের অনুমোদন সাপেক্ষে সিস্টেম তৈরির কাজ চলছে। লারনার্স অর্গানাইজেশন বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ পরিবারের উৎপাদিত পণ্য সামগ্রী বিপণনের জন্য বেড়া উপজেলায় স্থান বরাদ্দ দেওয়ার জন্য পৌরমেয়র অনুরোধপত্র প্রেরণসহ বাস্তবায়নের জন্য চেষ্ঠা চালিয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে অর্থের অভাবে কাজগুলি বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে।
লারনার্স অর্গানাইজেশন এর নির্বাহী পরিচালক জাহানারা বেগম বিজলীর সাথে তিনি জানান, পাবনার কিছু সচেতন মানুষকে নিয়ে পাবনার বেড়া উপজেলার সানিলা মহল্লায় বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ মানুষদের অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখাতে ২০০৭ সালে তাদের ভাগ্যউন্নয়নের জন্য তারা স্বাস্থ্যসেবা, প্রশিক্ষণ ও পুর্ণবাসন প্রকল্পের কাজ শুরু করেন। বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ শিশুদের লেখাপড়ার জন্য পাবনার বেড়া সানিলায় লারনার্স প্রতিবন্ধী অটিজম স্কুলের যাত্রা শুরু করেন । প্রথম দিকে ১৫ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু করেন শিক্ষা কার্যক্রম। বর্তমানে ১২টি কেন্দ্রেসহ তাদের স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১৬১ জন। তার প্রতিষ্ঠানে অন্ধ ছাত্রছাত্রী রয়েছে ১৫ জনের মত। প্রতি দুই মাস পরপর এদের উৎসাহ বাড়াতে গান বাজনাসহ কুইচ প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাচ্চাদের এবং বাচ্চার মাকে পুরুষ্কার প্রদান করে থাকেন তারা। এই প্রতিষ্ঠানটি ২০১৪ সালে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রানালয়ের রেজি: পায়। জাহানারা বেগম বিজলী আরও বলেন, সরকারী সহোযোগিতা পেলে বিশেষ চাহিদা সম্পূর্ণ মানুষদের ভাগ্যউন্ন্য়নে আরও কাজ করতে পারবেন।