মুক্ত চেতনা ডেস্ক : বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা)’র উদ্যোগে রাজশাহীতে নির্বিচারে পুকুর, জলাশয় ভরাট বন্ধের দাবিতে সোমবার (২০’ডিসেম্বর) ২০২১ খ্রি. নগরীর একটি রেস্টুরেন্টে এক গণস্বাক্ষর কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়।
গণস্বাক্ষর কর্মসূচি উদ্বোধন করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য্য প্রফেসর ড. সুলতানুল ইসলাম। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, রাজশাহী একটি পরিবেশবান্ধব নগরী হিসাবে পরিচিত। এই নগরীতে এক সময় উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুকুর ছিল। সময়ের ব্যবধানে নগরীর পুকুর, জলাশয় গুলো ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এতে প্রকৃতি, পরিবেশের ক্ষতি হচ্ছে। সেই সাথে জলবায়ু পরিবর্তনেও নেতিবাচক প্রভাব রাখছে। পুকুর, জলাশয় বন্ধে সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
বেলা’র উত্তরাঞ্চলের সমন্বয়কারী তন্ময় কুমার সান্যাল গণস্বাক্ষর কর্মসূচিতে ধারণাপত্র উপস্থাপন করেন। ধারণাপত্রে উল্লেখ করা হয়, রাজশাহী একটি ঐহিহ্যবাহী এবং দেশের উল্লেখযোগ্য বিভাগীয় শহর। রেশম, শিক্ষা এবং চিকিৎসা নগরী হিসাবেও রাজশাহী সুপরিচিত। একটি পরিচ্ছন্ন নগরী হিসাবে রাজশাহী দেশ-বিদেশে পরিচিতি পেয়েছে। পুকুরের নগরী হিসাবেও এক সময় এর পরিচিতি ছিল। নগরবাসী সেসব পুকুরের পানি প্রাত্যহিক কাজে ব্যবহার করতেন। এমনকি রাজশাহী নগরীর প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত ‘সোনাদীঘি’ নামক পুকুরের পানি নগরবাসী পান করতো বলে জানা যায়।
স্বাধীনতা উত্তর এই নগরীতে কয়েক হাজার পুকুর ছিল বলে জানা যায়। ২০১৪ সালের বোয়ালিয়া ভূমি অফিসের এক তথ্যে দেখা যায়, নগরীতে প্রায় এক হাজারের মতো পুকুর অবশিষ্ট ছিল। কিন্তু বর্তমানে পুকুরের সংখ্যা ২০০ এর নিচে নেমে গেছে। গত পনেরো বছরে নগরীর অধিকাংশ পুকুরই ভরাট করা হয়েছে। কখনো প্রকাশ্যে, আবার কখনো রাতের অন্ধকারে এই শহরের পুকুরগুলো এভাবে ভরাট করা হয়। পুকুর ভরাট করে সেখানে বাণিজ্যিক ভবন, অট্টালিকা বানানো প্রক্রিয়া চলমান। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যমতে, বিগত কয়েক দশকে নগরীর প্রায় ৯৭ ভাগ পুকুর/জলাশয় ভরাট করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কার্বন সংরক্ষণ, বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং ভূগর্ভস্থ পানির স্তর রক্ষায় পুকুর/জলাশয়ের অবদান অনস্বীকার্য।
রাজশাহী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (আরডিএ) প্রণিত ‘রাজশাহী মেট্রোপলিটন ডেভেলপমেন্ট প্ল্যাণ (২০০৪-২০২৪)’ এ নগরীর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক পুকুরকে সংরক্ষণযোগ্য হিসাবে উল্লেখ করা হলেও পুকুর ভরাট রোধে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তেমন কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেনি। অনুমতির তোয়াক্কা না করে কতিপয় ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান নগরীর পুকুরগলো একের পর এক ভরাট করে চলেছে, যেন দেখার কেউ নাই। এমনকি, নগরীর কোথাও বড় ধরণের অগ্নিকান্ড ঘটলে তা নির্বাপণের জন্য জলাশয় খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
প্রাকৃতিকভাবে এই অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কম। দেশের বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেখানে ২৫০০ মিলিমিটার, সেখানে রাজশাহী অঞ্চলে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১২০০-১৫০০ মিলিমিটার। গত পাঁচ দশকে এই অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর প্রায় ৫০-১০০ ফিট নিচে নেমে গেছে। সেই সাথে যোগ হয়েছে পুকুর/জলাশয় ভরাটের মতো মানবসৃষ্ট দুর্যোগ। ফলে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ভূগর্ভস্থ পানির স্তর পূণ:সঞ্চারণ হতে পারছে না। লাগাতার পুকুর ভরাটের কারণে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণ এবং তাপ শোষণ ব্যাহত হওয়ায় নগরীতে একদিকে অস্বাভাবিক গরম এবং অন্যদিকে অত্যাধিক শীত অনুভূত হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন, ১৯৯৫; মহানগরী, বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের পৌর এলাকাসহ দেশের সকল পৌর এলাকার খেলার মাঠ, উন্মুক্ত স্থান, উদ্যান এবং প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন, ২০০০ এবং দেশের প্রচলিত অন্যান্য আইনের বিধান অনুযায়ী জনস্বার্থের প্রয়োজন ব্যতিত এ ধরণের পুকুর/জলাশয়ের শ্রেণি পরিবর্তন করার কোনো সুযোগ নাই। এই অঞ্চলের আবহাওয়া এমনিতেই চরমভাবাপন্ন। তারপরেও যথেচ্ছাভাবে পুকুর/জলাশয় ভরাট করায় দিন দিন উত্তপ্ত হয়ে উঠছে নগরীর পরিবেশ। ফলে অতি গরম এবং অধিক শীতের কারণে ধীরে ধীরে নগরীর আবহাওয়া এবং স্বাভাবিক পরিবেশের মারাত্মক ব্যত্যয় ঘটছে। এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশ ব্যবস্থা হুমকীর সম্মুখীন মর্মে আশংকা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা) গণস্বাক্ষর কর্মসূচির মাধ্যমে রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন এলাকায় পুকুরসহ সকল ধরণের জলাশয় ভরাটের কার্যক্রম বন্ধকরণ এবং ভরাটকৃত পুকুর/জলাশয়গুলো পূন:রুদ্ধার করে তা সংরক্ষণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জোর দাবি জানানো হয়।
এ সময় গণস্বাক্ষর কর্মসূচিতে বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ মানুষ উপস্থিত ছিলেন।