॥ ড. মো. মনছুর আলম ॥
মানুষের আত্মচেতনা, আত্মপ্রকাশ ও আত্মপ্রচারের সবচেয়ে বড় মাধ্যম সংবাদ-সাময়িকপত্র। জাতীয় জাগরণ ও জনমত সৃষ্টিতে সংবাদ-সাময়িক পত্রের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সংবাদপত্র জাতি-গোষ্ঠী-সম্প্রদায় ও রাষ্ট্রের শুধু মুখপত্র হিসেবেই কাজ করে না; অনেক সময় মেরুদ-ের ভূমিকা পালন করে। দেশের রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি, ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি জ্ঞানের বিচিত্র বিষয় সংবাদপত্রে স্থান পায়। ফলে মানুষ অতি সহজে ও সূলভে এই নিত্য নিয়মিত বিদ্যার সাথে পরিচিত হবার সুযোগ লাভ করে। মানুষের বাক স্বাধীনতার অধিকার, অন্যায়-অবিচারের প্রতিবাদ, দাবি-দাওয়া আদায়, ন্যায়-নীতির প্রচার সংবাদ-সাময়িকীর দ্বারাই হয়ে থাকে। এছাড়া সংবাদপত্র বর্তমান ও অতীতের আর্থিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক জীবনের হালচাল, পারিপার্শ্বিক অবস্থার বিশ্লে¬ষণ ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের খোরাক জোগায় এবং মানুষের রাজনৈতিক চেতনা, হিতাহিত জ্ঞান ও চিত্তবৃত্তির বিকাশ সাধন করে থাকে।
বাংলার নবজাগরণের একটি শক্তিশালী মাধ্যম ছিল সংবাদ-সাময়িকপত্র। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলা তথা উপমহাদেশে সর্বপ্রথম মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হবার ফলে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও শিক্ষার ক্ষেত্রে এক নবজাগরণের সূচনা হয়। আর নবজাগরণের ক্ষেত্রে সংবাদ-সাময়িকপত্র মুখ্য ভূমিকা পালন করে। উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ১৭৮০ খ্রিস্টব্দের ২৯ জানুয়ারি কলকাতা থেকে ইংরেজি ভাষায় সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়। সম্পাদক ছিলেন জেস্ম আগাস্টাস হিকি। তিনি ‘বেঙ্গল গেজেট’ বা ‘ ‘Hicky’s Bengal Gazette or the Original Calcutta General Advertiser’ নামে একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক সাময়িকপত্র প্রকাশ করেন। পরবর্তীতে কলকাতা থেকে ÔBengal Journal(1785)’, `Bengal Hurkaru (1795)’ প্রভৃতি ইংরেজি সাময়িকপত্র প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকাগুলো ছিল বেসরকারি ইউরোপীয়দের মুখপত্র। এদের সাথে ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃপক্ষের ব্যবসায়িক স্বার্থ ও ব্যক্তিগত বিদ্বেষ প্রভৃতি কারণে বিরোধ ঘটে। ফলে ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদকরা এদেশ থেকে বিতাড়িত হতে বাধ্য হয় এবং লর্ড ওয়েলেসলি ‘গোটা সম্পাদক জাত’কে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য ১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দে কঠোর সেন্সর ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। পরবর্তীতে লর্ড হেস্টিংস-এর আমলে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে এই ব্যবস্থা বাতিল হয়। তবে শর্ত থাকে যে, সাময়িকপত্রে কর্তৃপক্ষ বিরোধী কোন সংবাদ ও মন্তব্য করা যাবে না। ঠিক এই সময় বাংলা সংবাদপত্রের যাত্রা শুরু হয়। জাতিকে জাগাতে, উন্নতির পথে পরিচালিত করতে হলে সংবাদপত্র প্রকাশ ও প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে; আর এ চিন্তা-চেতনায় সমাজের জন্য হাল ধরেন বাংলার তৎকালীন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত ও উচ্চ শ্রেণির ব্যক্তিরা। তাঁদেরই উদ্যোগে বাংলা ভাষাকে বাহন করে সংবাদ সাময়িকপত্রের যাত্রা শুরু হয়।
তবে তার আগে জন ক্লার্ক মার্সম্যান (১৭৯৪-১৮৭৭)-এর সম্পাদনায় শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশনের উদ্যোগে সর্বপ্রথম বাংলা সংবাদপত্র আলোর মুখ দেখে। তারা ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দের এপ্রিল মাসে কলকাতা হতে বাংলা মাসিকপত্র ‘দিগদর্শন’ প্রকাশ করেন। পরের মাসে তাঁরই সম্পাদনায় ২৩ মে কলকাতা হতে প্রকাশ পায় প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক ‘সমাচার দর্পন’। ঠিক একই বছর জুন মাসে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় বাঙালি সম্পাদিত ও পরিচালিত বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রথম সাময়িকপত্র সাপ্তাহিক ‘বাঙ্গালা গেজেট’। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন গঙ্গা কিশোর ভট্টাচার্য (মৃ. ১৮৩১)। এভাবে ৫০ বছরের ব্যবধানে মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক, অর্ধসাপ্তাহিক, দৈনিকসহ বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা প্রকাশিত হতে থাকে। ব্রিটিশযুগে দীর্ঘ প্রায় ১৩০ বছর চলার পর বাংলা তথা উপমহাদেশে সংবাদ-সাময়িকপত্র প্রকাশে এক বিপ্ল¬ব সাধিত হয়। এ ধারায় ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে দেশ বিভাগের পর শুধুমাত্র পূর্ববাংলা থেকে ২৭টি দৈনিক, ২০১টি মাসিক, ৫৭টি পাক্ষিক, ২৭টি ত্রৈমাসিক, ১৪টি দ্বিমাসিক, ১০টি ষান্মাসিক, ০৭ অর্ধ-সাপ্তাহিক, ০৭টি সংকলন, ০৬ টি বার্ষিকী, ০২টি চতুর্মাসিক, মহিলা পত্রিকা ১৭ টি, কিশোর পত্রিকা ৩৩টি, বিজ্ঞান ১৮টি ও ১১টি ধর্মবিষয়ক পত্রিকাসহ সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন দফতরের, দেশি-বিদেশি বিভিন্ন দফতরের মুখপত্র এবং প্রতিটি প্রশাসনিক ইউনিটের মুখপত্রসহ সর্বমোট ৪৬৭টি প্রত্রিকা প্রকাশের সন্ধান পাওয়া যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বাংলা পত্রিকার গণজোয়ার লক্ষ্য করা যায়, বিশেষকরে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে। বিশ্বায়ন, একবিংশ শতাব্দীর চাহিদা ও চ্যালেঞ্জ, ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ, স্মার্ট বাংলাদেশর স্বপ্ন পূরণ প্রভৃতিকে মাথায় রেখে দৈনিক পত্রিকাগুলো নব নব চিন্তা-চেতনা ও কৌশল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাচ্ছে পাবনা জেলা, ডিজিটাল যুগে পদার্পণ করেছে আমাদের প্রাণপ্রিয় সাঁথিয়া উপজেলা। ব্রিটিশ আমল থেকে পাবনা জেলায় অনেকগুলো সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকাসহ বিভিন্ন স্মরণিকা প্রকাশিত হয়ে আসছে, যে ধারা বর্তমানেও অব্যহত আছে। বর্তমানে স্থানীয় দৈনিক প্রত্রিকাগুলো তাদের কলেবর বৃদ্ধিসহ রঙিন, ঝকঝকে ছাপা, ফেসবুক পেজ, পিডিএপ পেজ, ওয়েব সাইট, অনলাইন পেজ, অনলাই পোর্টালসহ ডিজিটাল যুগে পদার্পণ করেছে। পাবনা হতে বহুল প্রচারিত জনপ্রিয় ৮ পৃষ্ঠার রঙিন পত্রিকা ‘দৈনিক সিনসা’; ইংরেজি পত্রিকা ÔDaily Morning Touch’ সহ শুধুমাত্র পাবনা শহর থেকেই ১৪টি স্থানীয় দৈনিক প্রত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। এছাড়া অনলাইন প্রত্রিকার তো ছড়াছড়ি। পাবনা জেলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা হিসেবে সাঁথিয়া উপজেলাও কম যাচ্ছে না। দৈনিক, অনলাইন, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকাসহ বিভিন্ন সংগঠেনের মুখপত্র, স্মরণিকা, পুস্তিকা প্রভৃতি প্রকাশ করে সাঁথিয়া তার প্রাচীন ঐতিহ্যপূর্ণ পথচলা ধরে রেখেছে। ব্রিটিশ আমল থেকে শুরু করে সাঁথিয়ায় বর্তমান অবধি যে সকল সাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, ত্রৈমাসিক পত্রিকাসহ বিভিন্ন সংগঠনের মুখপত্র, স্মরণিকা, পুস্তিকার সন্ধান পাওয়া যায় তা প্রকাশের কালানুক্রমিক বর্ণনা নি¤েœ তুলে ধরা হলো-
আরতি (১৯২৪); লাল পলাশ (১৯৭৪); দিশারী (১৯৮৪); জোয়ার (১৯৮৫); কিশোর কুঁড়ির মেলা, স্মরণিকা (১৯৮৫); পল্লীবাস সাহিত্য দর্পণ (১৯৮৫); তৃপ্তি ( ১৯৮৬); সৃজনী (১৯৮৭); আলোড়ন (১৯৮৮); মোগল জাতির ইতিহাস, পুস্তিকা (১৯৯০); ধানের শীষ, স্মরণিকা (১৯৯২); জননী ( ১৯৯৫); প্রয়াস (১৯৯৭); ঋত্বিক ( ১৯৯৯); সৃজন (১৯৯৯); পৃথিবীর পথে (২০০১); ষড়ঋতু (২০০২); আবাদ (২০০২); একতারা (২০০২); শৈশব (২০০৪); অপরূপা (২০০৪); বর্ণ বৃত্তান্ত (২০০৭); বনলতা (২০০৭); অবয়ব (২০০৮); ছলাৎ (২০০৯); চাতক (২০১০); হেরার আলো (২০১০), শেকড়ের টানে, ম্যাগাজিন (২০১২); প্রতিভা (২০১২); সাঁথিয়ার কণ্ঠ (২০১৪); আজকের মুক্তচিন্তা (২০১৫), আমাদের সাঁথিয়া (২০১৫); মাঠ (২০১৫); দুর্জয় সাঁথিয়া, স্মরণিকা (২০১৫); তোমার জন্মে ধন্য বাংলাদেশ, স্মরণিকা (২০১৬); একাত্তরে সাঁথিয়ার মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, পুস্তিকা (২০১৭); আলোর পরশ, স্মরণিকা (২০১৭); স্মৃতি স্মারক, স্মরণিকা (২০১৮); আমাদের সমাচার ২৪.কম অনলাইন (২০২০); (সূত্র- সাঁথিয়ার ইতিহাস, পৃ. ৯০-৯৮)। অনলাইন পোর্টালের মধ্যে আরও যেগুলোর সন্ধান পাওয়া যায় তা হলো- দৈনিক সংবাদ ২৪.কম (২০২০); ইছামতি নিউজ ২৪.কম (২০২১), ইত্যাদি। এই পত্রিকাগুলো সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ প্রকাশে দৃঢ়, নির্ভিকতার পরিচয় দিয়েছে এবং দিয়ে যাচ্ছে। পত্রিকাগুলো সাঁথিয়ার শিক্ষা, রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতি, ইতিহাস, ধর্ম, দর্শন, বিজ্ঞান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশে অগ্রণী, অনেকটা পথ-প্রদর্শকের কাজ করছে। নতুন বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে আধুনিক পাঠকের চাহিদা পূরণে নতুন নতুন চিন্তাধারা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে অনাগত কালের দিকে। ভবিষ্যতে সাঁথিয়া থেকে দৈনিক জাতীয় পত্রিকা প্রকাশিত হবে এই প্রত্যাশা।
নানা ঘাত-অভিঘাত, উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে যেমন সংবাদপত্র-সাংবাদিকদের বিকাশ সাধিত হয় তেমনি প্রেসক্লাব তাঁদের টিকে থাকার কৌশল শেখায়। সংবাদপত্র-সাংবাদিকতা ও প্রেস ক্লাব একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বা এক অপরের পরিপূরক; প্রেস ক্লাবকে সাংবাদিকদের বাহ্যিক রূপ বললেও অত্যক্তি হয় না। প্রেসক্লাব হলো সাংবাদিকদের বস্তুগত প্রকাশ। সাংবাদিকদের বস্তুগত ও মানুষসম্ভূত অবদানপুষ্ট সামাজিক মেল বন্ধনের পীঠস্থান হলো প্রেসক্লাব। প্রেসক্লাব-এর ‘প্রেস’ এবং ‘ক্লাব’ দুটোই ইংরেজি শব্দ। অক্সফোর্ড ডিকশোনারি press (প্র্রেস)-এর অনেকগুলো আভিধানিক অর্থ দাঁড় করালোও বাংলাদেশে এর বহুল প্রচলন সংবাদ, সংবাদপত্র, সাংবাদিক, সাংবাদিকতা, সংবাদমুদ্রণ অর্থাৎ সংবাদ-সংবাদপত্র সংশ্লিষ্ট কর্ম; যা সাংবাদিকদের সংঘবদ্ধ কর্ম বা Newspapers or journalists viewed collectively or an act of pressing something. ঠিক তেমনি Club (ক্লাব)-এরও অনেকগুলো আভিধানিক অর্থ থাকলেও এর বহুল প্রচলন সভা, সমিতি, সংঘ, সংস্থা, বৈঠকখানা; যা সংঘবদ্ধের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিশেষ কর্মসম্পাদন বা An association or organization dedicated to a particular interest or activity. পারিভাষিকভাবে ‘প্রেস ক্লাব’ বলতে মূলত পেশাদার সাংবাদিকদের সংঘবিশেষ যা বুদ্ধিবৃত্তি চর্চার পীঠস্থান; A press club is an organization for journalists engaged in the production and dissemination of news and discussion of intellect. বাংলাদেশের প্রধান প্রেসক্লাব ঢাকা ‘জাতীয় প্রেসক্লাব’ সাংবাদিকদের সামাজিক মিলনকেন্দ্র বা অবসর বিনোদনের স্থল হিসেবে প্রাথমিক যাত্রা শুরু করলেও ‘প্রেসক্লাব’ আভিধানিক বা পারিভাষিক সংজ্ঞার মধ্যে কখনো সীমাবদ্ধ থাকেনি। সীমাবদ্ধ থাাকেনি সাঁথিয়া প্রেসক্লাবটিও। স্ব-নিয়ন্ত্রিত স্ব-মহিমায় উদ্ভাসিত এর গঠনকাঠামো, গঠনতন্ত্র, লক্ষ্য-উদ্দেশ্য জেলা ও জাতীয় প্রেসক্লাবের সাথে কিছুটা সামঞ্জস্য হলেও অনেকটা স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে আবর্ত। আজ ২৩ আগষ্ট সাঁথিয়া প্রেস ক্লাবের শুভ জন্মদিন। শুভ জন্মদিন, শুভ জন্মদিন ‘সাঁথিয়া প্রেসক্লাব’, সুন্দর ও মসৃণ হোক আগামী পথচলা তোমার।
ইতিহাস ঐতিহ্যের প্রচীন লীলাভূমি, নৌপথে ব্যবসায়-বাণিজ্যের প্রাচীন উপকেন্দ্র; আত্রাই-মাদলাই, কাকেশ^র-কাগেশ^রী, বলেশ^র-ইছামতি নদীর দান-প্রেম-ভালোবাসায় শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে নদী মেঘলা, পলি বিধৌত সুজলা-সুফলা, সশ্য-শ্যামলা আমাদের এই প্রিয় ভূখ-টি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অপার মহিমা ও দানে কোমল-নরম ও নমনীয় ঊর্বরা-ভূমির ঐশ^র্যম-িত সৌন্দর্যের লীলাভূমি আমাদের সাঁথিয়া উপজেলা। আর এই উপজেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে ইছামতি নদীর তীরে আজ থেকে ৪০ বছর পূর্বে ১৯৮১ সালের এই দিনে সাঁথিয়ার কয়েকজন নিবেদিতপ্রাণ সংবাদকর্মীর প্রচেষ্টায় গড়ে উঠেছে ‘সাঁথিয়া প্রেসক্লাব’। বৈশি^ক করোনা মহামারির কারণে সবকিছু সংকুচিত হয়ে আসছে; হতে বাধ্য করছে। তবুও ক্লাবটি তার ‘রুবি জুবিলি’ (Ruby Jubilee) উদ্যাপনে সামান্যমত কার্পণ্য করেনি; ডিজিটাল পদ্ধতির মাধ্যমে অত্যন্ত জাঁকজমক ও সারম্ভরপূর্ণ ভাব বজায় রেখেছে। ‘রুবি জুবিলি’ উদ্যাপনে ক্লাবটি অত্যন্ত মেধার পরিচয় দিয়েছে জেনে একজন সাঁথিয়ার সন্তান হিসেবে গর্ববোধ করছি।
বাংলদেশের প্রখ্যাত কবি শামসুর রহমান ও সাংবাদিক গিয়াস কামাল চৌধুরীর স্মৃতিধন্য আমাদের এই ‘সাঁথিয়া প্রেসক্লাব’। শুরু থেকে ক্লাবটি যেমন সাংবাদিকদের সংঘবদ্ধ করে আসছে তেমনি তাঁদের সংঘবদ্ধ কর্ম ও প্রচেষ্ঠার কারণে আজ নিপীড়িত, বঞ্চিত, মজলুম জনতার আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়েছে। স্বৈরশাসনের দুঃসহ দিনগুলোকে মাথায় নিয়ে চলা আন্দোলন-সংগ্রামে অগ্রণী হওয়া প্রেসক্লাবের চলার পথ অতটা মসৃণ ছিল না। তবুও দেশের বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় ইস্যুতে প্রতিবাদী হয়েছে, অধিকার আদায়ে নির্ভিক হয়েছে, সর্বোপরি সামাজিক নানা কর্মে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলছে। সাংবাদিক সম্মেলন, সভা-সেমিনার, মানববন্ধন করছে। দেশের গণতন্ত্র, নির্বাচন পদ্ধতি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে সোচ্চার হয়েছে, কলম যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে; এই কালোআইনে মামলা ও গ্রেফতারকৃত সহযেদ্ধা সাংবাদিকদের মুক্তির জন্য রাজপথ কাঁপিয়েছে, আনশন, মানববন্ধনসহ নানান কর্মসূচি দিয়েছে। এছাড়া দেশ-জাতি-সম্প্রদায় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক ইস্যুতে সোচ্চার হতে দেখা গিয়েছে সাঁথিয়া প্রেসক্লাবকে’। দেশের বিভিন্ন জাতীয় ও গুরুত্বপূর্ণ দিবসগুলো যেমন, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ও শহিদ দিবস, মহান স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, জাতীয় শিশুদিব, জাতীয় শোকদিবসসহ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসগুলো যথাযথ মর্যাদার সাথে উদ্যাপান করছে।
একঝাঁক নিবেদিতপ্রাণ সংবাদকর্মীর পদচারণায় সর্বদা মুখরিত সাঁথিয়া প্রেসক্লাবের রয়েছে নিজস্ব জায়গায় দৃষ্টিনন্দন বিল্ডিং, সুসজ্জিত অফিস, অফিস কাম অডিটোরিয়াম, নিজস্ব অর্কাইভস, নিজস্ব জনবল, গঠনকাঠামো, গঠনতন্ত্র, সুসজ্জিত পাঠাগার, লেখক ফোরাম, পাঠক ফোরাম, ডজন ডজন লক্ষ্য-উদ্দেশ্যের ডালি সাজিয়ে কড়া নাড়ছেন সাঁথিয়বাসীর দোয়ারে দোয়ারে। তারা শুধু আম-জনতা নয় সাঁথিয়ার শিক্ষার্থীদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নেতৃত্ব প্রদানের উপযোগী করে গড়ে তোলার মানসে নিজেরা লেখালেখি, লিখতে উদ্বুদ্ধ করা, পত্রিকায় লেখা ছাপা, ছাপানোর ব্যবস্থা করা, পত্রিকা পাঠের ব্যবস্থা, শিক্ষার্থী-লেখক-কবি-সাহিত্যিকদের পড়ার সুযেগ প্রদান, বিনোদনসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক কর্ম ও পুরস্কার বিতরণ করে আসছে। এছাড়া গুণীজন সম্মাননা, বিদায় সম্মাননা, মেধাবী শিক্ষার্থীদের সম্মাননা, কবি-সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষকতা, প্রভৃতি কর্ম করে ‘সাঁথিয়া প্রেসক্লাব’ এখন সাঁথিয়াবাসীর গর্বের পীঠস্থানে পরিণত হয়েছে। ‘সাঁথিয়া প্রেসক্লাব’ বিভিন্ন মানবিক, সমাজকল্যাণ ও আর্তসেবামূলক কার্যক্রম পরিচলনা করে সচেতন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পেরেছে বলে মনে হয়। ইতিহাসের বিবর্তনে ‘সাঁথিয়া প্রেসক্লাব’ গৌরবের ৪০ বছর অর্থাৎ ‘রুবি জুবিলি’-এর বুদ্ধিদীপ্ত উদ্যাপন সত্যিই আমাকে মুগ্ধ করছে; মুগ্ধ করছে প্রশাসনসহ সমগ্র দেশবাসীকে। দীর্ঘজীবী হোক ‘সাঁথিয়া প্রেস ক্লাব’ পরিবার, কলেবর আরো বৃদ্ধি পাক, সুসমৃদ্ধ হোক তাদের চিন্তা-চেতনা, সত্য-ন্যায় ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশনে হোক আরো আরো নির্ভিক; তেজদীপ্ত হোক আগামী পথচলা, এই প্রত্যাশা।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক; সহকারী অধ্যাপক, সাঁথিয়া মহিলা ডিগ্রি কলেজ।