॥ ড. মো. মনছুর আলম ॥
উপমহাদেশের অতি প্রাচীন ভূখ- পাবনা অঞ্চল। এ অঞ্চলরে জনবসতির ইতিহাসও সুপ্রাচীন। বঙ্গভূমির সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করলে পাবনা জেলার জনবসতি ও সভ্যতার ইতিহাসের ধারনা মিলবে। বঙ্গভূমিতে প্রায় ৭ হাজার বছর পূর্বে আন্দামান দ্বীপপুঞ্জ ও মালয় উপদ্বীপ হতে নেগ্রিটো বা নিগ্রোবটু জাতি, ৬ হাজার বছর পূর্বে ইন্দোচীন থেকে অস্ট্রোলয়েড বা অস্ট্রিক জাতি, ৫ হাজার বছর পূর্বে দ্রাবিড় জাতি; অবশ্য এ সময় কিছু মোঙ্গলীয় ও ভোটচীনীয় নরগোষ্ঠীর আগমন ঘটে এবং বসতি স্থাপন করে। অতঃপর আড়াই হাজার বছর পূর্বে আগমন ঘটে আর্য জাতির। এইসব প্রাগৈতিহাসিক যুগের জাতি ছাড়াও ঐতিহাসিক যুগের জাতিসমূহ সভ্যতা-সংস্কৃতি বিকাশে চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। বঙ্গভূমির সভ্যতার ইতিহাস পর্যালোচনা করে বলা যায়, বঙ্গ সভ্যতার ইতিহাস সর্বোপরি প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের ইতিহাস। বাংলার ঐতিহাসিক-গবেষকগণও এমনটাই মনে করেন। পাবনা জেলাও এর ব্যতিক্রম নয়। অতএব, পাবনা অঞ্চলের নদী ও কৃষিভিত্তিক সভ্যতা-সংস্কৃতির ইতিহাস মোটাদাগে আমরা বলতে পারি প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের ইতিহাস। পাবনা সভ্যতার এই সাড়ে তিন হাজার বছরের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন ছাড়া পাবনার মাটি থেকে আর কোনো রাষ্ট্রপতি বা রাষ্ট্র প্রধানের জন্ম হয়নি।
পাবনা জেলা পুণ্ড্রবর্ধণ রাজ্যের অংশ হিসেবে মৌর্য সাম্রাজ্যের (৩২১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৮৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত) অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মৌর্য যুগ পর্যন্ত অনুসন্ধান করে পাবনার মাটি থেকে কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বা প্রশাসকের সন্ধান পাওয়া যায়নি। মৌর্যযুগের পর পাবনা গুপ্তযুগে (২৭৫ থেকে ৫৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত) প্রবেশ করে। এই সময় পাবনা অঞ্চলে একজন যোগ্য প্রশাসক কুমারগুপ্তের (৪১৪-৪৫৫ খ্রি.) সন্ধান পাওয়া যায়; যিনি বিহারের ‘নালন্দা বিশ^বিদ্যালয়ে’র প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। কুমারগুপ্তের সময় পাবনা ব্যবস্যায়-ব্যাণিজ্য, বিশেষ করে নৌবাণিজ্য; ধর্ম-শিক্ষা-সংস্কৃতি বিশেষ করে বৌধধর্ম চর্চা ও বিহার কেন্দ্রিক লেখাপড়ায় অনেক অগ্রসর হয়। আইন-ই-আকবরী গ্রন্থ হতে জানা য়ায়, পুন্ড্রবর্ধণের অন্তর্গত শেলবর্ষ বৌদ্ধদের পবিত্র স্থান ছিল আর এই শেলবর্ষ সরকার বাজুহার অন্তর্গত পাবনাকে বুঝানো হত। কুমারগুপ্তের শিলালিপিতেও পু-্রবর্ধণ ভুক্তির উল্লেখ আছে। কুমারগুপ্ত নিজে এই ভুক্তিকে অর্থাৎ পাবনাকে প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে রেখেছিলেন। পাবনা শহরের অদূরে ধানাইদাহ্-তে কুমারগুপ্তের ‘ধানাইদাহ্ তা¤্রশাসন’ পাওয়া গিয়েছে। ধানাইদাহ্ পদ্মা নদীর শাখা ‘খলিশা ডাঙা’ নদীর তীরে অবস্থিত একটি প্রাচীন শহর। ধানাইদাহ্ তা¤্রশাসন থেকে জানা যায়, গুপ্ত স¤্রাট কুমারগুপ্ত পাবনাসহ অত্র অঞ্চলের একজন যোগ্য প্রশাসক ছিলেন। কুমারগুপ্ত পাবনা জেলার সর্বপ্রথম যোগ্য প্রশাসক হলেও তিনি পাবনার ধূলো-মাটির সন্তান ছিলেন না।
গুপ্ত স¤্রাট স্কন্ধগুপ্তের পর পরবর্তী স¤্রাটদের সিংহাসন নিয়ে অন্তর্কলহ, হুনজাতির ক্রমাগত আক্রমণ, বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাবে অহিংস নীতি গ্রহণ, সামরিক শক্তিকে অবহেলা সর্বোপরি সম্রাটদের অযোগ্যতা ও দুর্বলতার সুযোগে সা¤্রাজ্য বিভিন্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে বিভক্ত হয়ে স্বাধীন হয়ে পড়ে। এই বিশৃঙ্খলপূর্ণ সময়ে পাবনা মূলত স্বাধীন ছিল। এই স্বাধীন আমলেও কোন রাজা-বাদশার সন্ধান পাওয়া যায়নি। এ সময় বাংলাদেশে দুটি শক্তিশালী স্বাধীন রাজ্যের সৃষ্টি হয়, একটি বঙ্গরাজ্য অপরটি গৌড়রাজ্য। ফলে এখন থেকে বঙ্গভূমির প্রাচীন নামগুলো যেমন- পুণ্ড্র, সুহ্ম, সমতট লোপ পায়। সাধারণত দক্ষিণ-পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় স্বাধীন বঙ্গ রাজ্য। আর উত্তরবঙ্গ (পুণ্ড্রবর্ধণরাজ্য) ও পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে গঠিত হয় গৌড় রাজ্য। পাবনা গৌড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। রাজা শশাঙ্কের (৬০০-৬৩৮ খ্রি.) ক্ষমতা গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত পাবনা জেলা কার্যত স্বাধীন ছিল। শশাঙ্কের পর শুরু হয় অরাজকতা ও বিশ্খৃলার যুগ; যাকে ঐতিহাসিকগণ ‘মাৎস্যন্যায়’ যুগ বলে আখ্যায়িত করেছেন। এই যুগে পাবনাসহ সমগ্র বঙ্গভূমি প্রায় দেড়’শ বছর অহেতুক গোলযোগ, হাঙ্গামা ও রাজনৈতি বিশৃঙ্খলা, কেন্দ্রীয় শাসন না থাকা, বৈদেশিক আক্রমণ, লুটপাট চরম পর্যায়ে পৌঁছালেও পাবনা অঞ্চল থেকে কোনো যোগ্য শাসক জন্মেনি। অতঃপর পাবনা প্রবেশ করে পাল রাজত্বে (৭৫০-১১৬১ খ্রি.)। এ সময় পাবনকে শিক্ষাদীক্ষা, ধর্মে-কর্মে, জ্ঞান-গরিমায় অনেকটা অগ্রসর হতে দেখা যায়। পালদের পর বহিরাগত সেনরা (১০৭০-১২৩০) ক্ষমতায় আসে। এই দুই আমল অর্থাৎ পাল ও সেন আমল পর্যক্ষেণেও পাবনা জেলার কোন প্রশাসকের সন্ধান পাওয়া যায়নি।
১২০৪ সালে বখতিয়ার খলজি বাংলা বিজয় করলে নববিজিত রাজ্যের শান্তি শৃঙ্খলা বিধানের নিমিত্তে তিনি সমগ্র রাজ্যকে তিনটি প্রসাশনিক ইউনিট বা ‘ইকতা’য় বিভক্ত করেন। তিনজন সেনাপিতির উপর ইকতার শাসনভার অর্পণ করে বখতিয়ার খলজি তিব্বত অভিযানে যান। পাবনাসহ পদ্মার তীরাঞ্চলের দায়িত্বে থাকা সেনাপতি হুসামউদ্দিন ইওয়াজ খলজি পরে রাষ্ট্রপ্রধান হলেও তিনি পাবনার সন্তান ছিলেন না; ছিলেন তুর্কিস্তানের অধিবাসী। অতঃপর সুলতানী আমল, পাঠানদের অধীন, কররাণী বংশের অধীনে বাংলা শাসিত হলেও পাবনার মাটি থেকে কোন শাসকের জন্ম হয়েছে বা রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলেন এ রকম কোনো তথ্য বা সন্ধান পাওয়া যায় না। এমনকি মোগলদের আগে স্বাধীন বারো ভূঁইয়াদের কেউ পাবনার সন্তান ছিলেন না। মোগল আমলে পাবনা মোগল-পাঠানদের অবাদ বিচরণভূমি; রাস্তাঘাট নির্মাণ যেমন- শায়েস্তা খাঁ রোড, আওরঙ্গজেব রোড, সিরাজ-উদ-দৌলা রোড ইত্যাদি; পাবনা বড়বাজার স্থাপন; শহরে সেনানিবাস(ছাতিয়ানী) স্থাপন, সেনানিবাস থেকে কুঠিপাড়া-সাধুপাড়া হয়ে মন্ডলপাড়া পর্যন্ত সংযোগ খাল খনন; অনেকগুলো পুকুরপুষ্করিণী তৈরীসহ নানা কর্মযোজ্ঞের সন্ধান পাওয়া যায়। এত কিছুর সন্ধান পাওয়া গেলেও পাবনার সন্তানদের প্রশাসক হওয়ার কোনো খবর পাওয় যায়নি। তবে এই সময় কয়েকজন শক্তিশালী জমিদার-এর সন্ধান পাওয়া যায়। এছাড়া কিছু কানুনগো, মহাজন ও ইজারাদার পাবনার মাটি থেকে বের হয়ে আসেন। তাঁরা শক্তি সামর্থে জ্ঞান গড়িমায় শক্তিশালী হলেও পরাধীন ছিলেন।
ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশরাজ ৩১২৪ নং পত্রানুসারে রাজশাহী জেলা হতে পাবনা জেলাকে ১৬ অক্টোবর ১৮২৮ সালে আধুনিক জেলা হিসেবে ঘোষণা করেন। শুরু হয় আধুনিক পাবনার পথচলা। তারা পাবনাতে রেল লাইন স্থাপন, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, পাকশি রেল জংশন নির্মাণ ও ঈশ^রদী বিমান বন্দর তৈরী করেন। পাবনাকে আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত শহর হিসেবে গড়ে তুলতে ১৮৭৬ সালে পাবনা পৌরসভা প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়া ১৮৭৯ সালে জেলা জজের পদ জারি, ১৮৮৪ সালে সুরম্য দ্বিতল জজকোর্ট ভবন নির্মাণ (যা এখনও বর্তমান), ফৌজদরি আদালত, জেলা বোর্ড, পৌর ভবন, জেলখানা, পোস্ট অফিস, টাউন হল, অন্নদা গোবিন্দা পাবলিক লাইব্রেরি, দাতব্য চিকিৎসালয়, জেলা স্কুলসহ পাবনা নানা ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই আমলে কয়েকজন শক্তিশালী জমিদার গড়ে উঠলেও তাঁরা পরাধীন ছিলেন। তবে ব্রিটিশ আমলে পাবনায় বেশ কয়েকজন সূর্যসন্তানের জন্ম হয়।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হলে পাবনা পূর্ব-পাকিস্তানের একটি শক্তিশালী জেলা হিসেবে নিজেদের অবস্থান জানান দেয়। এ সময়টাতেও পাবনায় অনেক সূর্যসন্তানের জন্ম হয়। পূর্বপাকিস্তান জনআধিক্যের কারণে মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী, গভর্নর, প্রেসিডেন্ট ধীরে ধীরে সবই পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের উপনিবেশবাদী ও শ্বৈরাচারী মনোভাব শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌমের দিকে অগ্রসর হতে বাধ্য করে। তাদের শ্বৈরাচারী মনোভাবের কারণে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েও আমরা ক্ষমতায় যেতে পারেনি। ১৯৭১ সালে মহাকাব্যিক যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীন হলে পাবনা জেলার ব্যাপক শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। ১৯৮৪ সালে দেশের প্রশাসনিক কাঠামোর ব্যাপক পরিবর্তন সাধিত হয়। এ সময় প্রতিটি মহকুমাকে জেলায় এবং প্রতিটি থানাকে উপজেলায় উন্নীত করা হয়। এছাড়া উপজেলাকেও দেশের প্রশাসনিক কর্মকান্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর হিসেবে চিহ্ণিত করা হয়। ফলে পাবনা জেলাকে ভেঙে সিরাজগঞ্জকে জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই সময় অর্থাৎ প্রেসিডেন্ট এরশাদ সরকারের আমলে বৃহত্তর পাবনার কৃতি সন্তান জনাব এম এম মতিন উপ প্রধানমন্ত্রী হন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় তিনি এমন সময় হলেন যখন পাবনা জেলাকে দ্বি-খ-িত করা হলো। পাবনাবাসীর জন্য আরো মহাদুঃখের কারণ হলেন আবার বিনিই। জনাব মতিন সাহেব বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুকে পাবনা নগরবাড়ি থেকে কেটে সিরাজগঞ্জ নিয়ে গেলেন। এই লজ্জা ও দুঃখের বোঝা মাথায় নিয়ে পাবনাবাসীকে দীর্ঘ অপেক্ষার প্রহর গুনতে হলো। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর দেশ ইতোমধ্যে ২১ জন রাষ্ট্রপতি উপহার দিয়েছেন। স্বাধীনতার ৫২ বছর পর এলো পাবনাবসীর জন্য সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ২২তম রাষ্ট্রপতি; পাবনার ধূলো-মাটি, আলো-বাতাসে তরতর করে বেড়ে উঠা পাবনার সূর্য-সন্তান মো. সাহাবুদ্দিন। আমরা গর্বিত আমরা উৎফুল্ল, আমাদের মহাখুশির দিন আজ। আমাদের জন্য যেমন আনন্দের তেমনি অত্যন্ত মর্যাদা ও গর্বের। পাবনা সারাদেশে যেমন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে তেমনি বিশ্বেও। পাবনা অনেক অনেক এগিয়ে যাবে, পাবনার ইতিহাস এখন অন্যভাবে লিখিত হবে। বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি পাবনার সূর্য-সন্তান মো. সাহাবুদ্দিন-এ দীর্ঘায়ু কামনা করি। [লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও গবেষক।]