।। ড. মো. মনছুর আলম।।
মুসলিম মানসে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ও মুসলিম জাতীয়তার বিকাশে যে সকল মুসলিম মনীষীর নাম শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে উচ্চারিত হয়, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী। তিনি একাধারে বাংলার মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত, সুসাহিত্যিক, কবি, প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক, ধর্মীয় নেতা, সাংবাদিক, রাজনীতিক, সমাজসেবক ও শ্রেষ্ঠ বাগ্মী ছিলেন। সেসময় স্বজাতির কল্যাণ চিন্তায় বজ্রমুখ লেখনী, আপোষহীন রাজনীতি ও বাগ্মীতার মাধ্যমে বাংলার মুসলমানের নবজাগরণের পুরোধা ব্যক্তিত্বরূপে আবির্ভূত হন ইসমাইল হোসেন সিরাজী। ইসলামের মহাত্ম প্রচার ও মুসলিম জাগরণমূলক সাহিত্য রচনাকে তিনি জীবনের ব্রত হিসেবে গ্রহণ করেন। এই দ্বিবিধ কর্মের উন্মেষ ঘটে মুনশী মোহাম্মদ মেহের উল্লাহর প্রত্যক্ষ অনুপ্রেরণায়; আর সাথী হিসেবে পেয়েছিলেন মুসলিম জাগরণকামী ব্যক্তিত্ব মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ ও মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীকে। ইসমাইল হোসেন সিরাজীর সমগ্র লেখনীসত্তা ছিল বাংলার মুসলিম জাগরণ প্রয়াসে নিবেদিত। কাব্য, প্রবন্ধ, নিবন্ধ কিংবা ঔপন্যাস সর্বত্রই তাঁর আরাধ্য বিষয়ের তেজদীপ্ত প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর রচনাসমূহ বিষয় বৈচিত্র্যে ভরপুর হলেও এর আন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ছিল একটাই; তা হলো বাংলার মুসলিম জাগরণ। তেমনি তাঁর বক্তৃতার প্রধান বিষয়বস্তু ছিল বাংলার অচেতন, অনগ্রসর মুসলিম সমাজকে জাগরণের মন্ত্রে উদ্দীপ্ত করা, জাগিয়ে তোলা। আমাদের জাতীয় পুনর্জাগরণের ইতিহাসে তাঁর অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এবং শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয়।
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী ১৩ জুলাই ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে সিরাজগঞ্জ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ আবদুল করিম ও মাতার নাম নূরজাহান বেগম। তাঁর পিতা আবদুল করিম একজন নিষ্ঠাবান, কর্তব্যপরায়ণ, পরহেজগার ও ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন। মাতা নূরজাহান বেগমও একজন বিদূষী পূণ্যবতী মহিলা ছিলেন। সৈদয় ইসমাইল হোসেন সিরাজীর উর্ধ্বতন পূর্বপুরুষ হাকিম সৈয়দ আসেক উল্লাহ মোগল শাসনামলে পারস্যের সিরাজ নগর থেকে দিল্লিতে আগমন করেন। এখান থেকে তাদেরই এক ঊর্ধ্বতন পুরুষ বাংলার রাজধানী রাজমহলে এসে বসতি স্থাপন করেন। এখান থেকে তাদের চতুর্থ পুরুষ সৈয়দ শরিয়ত উল্লাহ আসেন মুর্শিদাবাদে। পরে মুর্শিদাবাদ থেকে সৈয়দ ইসমাইল হোসেনের পিতা সৈয়দ আবদুল করিম দুই ভাইসহ বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার খোকসা থানার অধীন পদ্মা নদীর তীরে এক ক্ষুদ্র গ্রাম আমলাবাড়িতে বসতি স্থাপন করেন। নদী ভাঙনে গ্রামটি সম্পূর্ণরূপে নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেলে সৈয়দ আবদুল করিম আত্মীয়স্বজনসহ পদ্মার অপর পাড়ে পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ (বর্তমান জেলা) শহরে এসে বসতি স্থাপন করেন। তিনি এখানে একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। এই বাড়িতেই সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী জন্মগ্রহণ করেন। সিরাজী এ বাড়ির নাম দেন বাণীকুঞ্জ।
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী শৈশবে মায়ের নিকট আরবি পড়তেন এবং পুঁথি সাহিত্য শুনতেন। পুঁথির মাধ্যমে মুসলমানদের অতীতের শৌর্যবীর্য এবং গৌরবময় ঐতিহ্যের কাহিনি তাঁর কিশোর মনে গ্রোথিত হয়। ফলে উত্তরকালে মুসলমানদের অতীত গৌরবের প্রতি তাঁকে আগ্রহী করে তোলে। শৈশবকালে সিরাজীর লেখাপড়ার প্রতি ঝোঁক দেখে পিতা-মাতা ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে স্থানীয় পাঠশালায় ভর্তি করেন। অতঃপর ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানদায়িনী মাইনর স্কুলে (মধ্য ইংরেজি বিদ্যালয়) থেকে কৃতিত্বের সাথে ছাত্র-বৃত্তি পাশ করেন এবং বনোয়ারীলাল উচ্চ বিদ্যালয়ে (বিএল হাইস্কুল) ৯ম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। এরপর আর তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক পড়ালেখার সুযোগ হয়নি। তবে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা গ্রহণ করতে না পারলেও তিনি মেধাচর্চা থেকে নিজেকে সড়িয়ে রাখেনি। তিনি ছাত্রাবস্থায়ই পত্র-পত্রিকা পাঠ, বাগ্মীতা, বিতর্ক চর্চা, সাহিত্য ও ইতিহাস চর্চা, বিভিন্ন প্রবন্ধ পত্রিকায় প্রকাশ করা, কবিতা রচনা প্রভৃতি বিষয়ে মনোযোগ দেন।
সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী বাংলার মুসলিম জাগরণের মানসে লেখালেখি ও বাগ্মীতাকে বেছে নেন। তবে তিনি সামাজিক-রাজনৈতিক আন্দোলন ও ইসলাম প্রচারে বাগ্মীতাকে বেশি প্রাধান্য দিতেন। জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় পর্যাপ্ত পড়াশোনা করার কারণে অনর্গল ওজস্বিণী ভাষায় ঘন্টার পর ঘন্টা তিনি বক্তৃতা দিতে পারতেন। এক্ষেত্রে তিনি প্রতেক্ষ অনুপ্রেরণা লাভ করেন যশোরের মুনশী মেহের উল্লাহর কাছ থেকে। সিরাজীর সভাসমূহে মানুষ পঙ্গপালের ন্যায় ছুটে আসত এবং মুসলিম জাগরণমূলক বক্তৃতা শুনে বিমোহিত হতো। তাঁর বক্তৃতার বিষয়বস্তু সমন্ধে ড. মো. শহীদুল ইসলাম নূরী বলেন, “ইসলামের নীতি শিক্ষা ও সভ্যতা, মুসলমানের বিশেষত ছাত্র ও তরুণের কর্তব্য, শিক্ষা, হিন্দু মুসলমানের ঐক্য, রাসূল (সা.) এর জীবনের অনুপম আদর্শ ও শিক্ষা, বাংলার মুসলমানদের অধঃপতনের কারণ ও প্রতিকার, মুসলমানদের গৌরবময় অতীত ও ঐতিহ্য, মুসলিম নারী জাগরণ, ইসলামের নামে সমাজে প্রচলিত কুসংস্কারের মূলোৎপাটন, স্বাধীনতা সংগ্রাম, ব্যবসায়-বাণিজ্যের সকল স্তরে মুসলমানের অংশগ্রহণ এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ যে কোন জাতির সাথে প্রতিযোগিতা ইত্যাদি।” তাঁর বক্তৃতার বিষয়বস্তুর উপর আলোকপাত করলে দেখা যায় যে, তিনি বাংলার মুসলিম জাগরণের সকল অন্তরায়সমূহ সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছেন এবং এ সকল প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে উঠার উপায়ও নির্দেশ করেছেন।
সিরাজীর অনল উদ্গীরণকারি জ্বালাময়ী বক্তৃতা প্রসঙ্গে সমকালীন অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত করেছেন। আবদুল কাদির সিরাজীর এক বিশাল সভায় পিনপতন নিরবতার মাঝে সূরা ফাতিহার অভিনব সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং ন্যায়নীতি সম্পর্কিত ব্যাখ্যা শুনেছেন। স্মৃতি কথায় তিনি বলেন, “তাঁর এ সকল যাদুকরী বাণী ও ব্যাখ্যা ঝড়ের দোলার মতো মানুষকে চমকিত করত। হীনমন্যতাবোধে আক্রান্ত মুসলামন হতো অভিভূত হতো উদ্দীপ্ত।” আবুল ফজল তাঁর ‘রেখাচিত্র’ গ্রন্থে মন্তব্য করেছেন, “গত রাতে সিরাজী সাহেবের বক্তৃতা শুনতে গিয়াছিলাম ঘাড় কাৎ করে যে দাঁড়িয়ে ছিলাম, বক্তৃতা শেষ হওয়ার আগে ঘাড় সোজা করার হুঁশই ছিল না, ফলে ঘাড়ে ব্যথা হয়ে যায়।” ফজলুল হক সেলবর্ষী তাঁর জ্বালাময়ী বক্তব্যকে ঈসা-মসীহর মুর্দাকে জিন্দা করার বাণী হিসেবে অভিহিত করে বলেন, “অর্ফিয়াসের বাঁশির মত তাঁর বাঁশির সুরে আত্মহারা মুসলানের জীবন-নদী সেদিন বহিয়াছিল উজান স্রোতের টানে। নিরাশাচ্ছন্ন নিযুত মানুষ সেখানে বিস্ময়ে শুনিয়াছিল তাঁর জাগরণী গান, নব জেন্দেগীর পয়গাম। সকল দেশে ও সকল কালে যে কবি শুনাইয়াছেন যত বেশি আশার কথা, মানুষ ততোবেশি করিয়া ভালো বাসিয়াছে তাহাদের সেই জাতীয় কবিকে। সিরাজী সাহেবের কৃতিত্বের সঙ্গে আবার যোগ দিয়েছিল তাঁহার অপূর্ব বাগ্মীতা।”
বাগ্মী সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী সমকালীন মুসলিম সমাজের এক অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। তাঁর বক্তৃতার অন্যতম লক্ষ্য ছিল স্বজাতিকে অধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে গড়ে তোলা এবং উন্নত জাতির সাথে প্রতিযোগিতায় আহ্বান জানানো। ইসমাইল হোসেনের উদ্দেশ্য ছিল সুসলিম জাতিকে যুগোপযোগী গড়ে তোলার মানসে স্বজাত্যবোধে উদ্বুদ্ধ করা এবং সর্বোপরি জাগরণমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করে দেশ-মাতৃকার স্বাধীনতা অর্জন। সিরাজীর বাগ্মীতার প্রভাব এতটাই প্রবল ছিল যে, যেখানে তিনি সভা-সমাবেশ করতেন সেখানেই কিছু না কিছু পরিবর্তন ঘটতো। এমনও দেখা গেছে ঐ অঞ্চলে কিছু দিনের মধ্যে স্কুল, মাদ্রাসা, বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হতে। বাংলার মুসলমানদের জাতীয় দুর্দিনে তাঁর চিন্তা-চেতনা ও কর্ম; তাঁর অনলবর্ষী বক্তৃতা বাঙালি মুসলিম জাতিকে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত করেছে, আলোর পথ দেখিয়েছে এবং দিয়েছে নবজাগরণের উম্মাদনা। বৃহত্তর পাবনা জেলার এই বিখ্যাত মুসলিম মনীষীর ১৪৩ তম জন্মবার্ষিকীতে রইল গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। [ লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক; সভাপতি, সাহিত্য ও বিতর্ক ক্লাব পাবনা। ]