আখতার রহমান (রাজশাহী) : ভাঁজভাঙ্গা লুঙ্গি আর ফতুয়া পরে বিছানায় বসে ছিলেন ৭৫ বছর বয়সের মকবুল হোসেন। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, ‘আগে পরিবারের সঙ্গে থাকতাম। সবকিছু ছেড়ে এখন আছি বৃদ্ধাশ্রমে। মকবুল হোসেন সঙ্গে কথা হচ্ছিল ‘সরের হাট কল্যাণী শিশু সদন’ ও ‘মমতাজ আজিজ’ নামের বৃদ্ধাশ্রমে। অভিভাবকহীন এই আশ্রয়কেন্দ্রে আছেন মকবুল হোসেনের মতো আরও ১০ জন প্রবীণ ব্যক্তি এবং ৫০জন নারী। এছাড়া সেখানে বর্তমানে রয়েছে ১৪০ জন এতিম শিশুদের মধ্যে ১০৫ জন ছেলে ও ৩৫ জন কণ্যা শিশু। যাঁদের ঈদ, পূজা, পার্বণসবই এখন এই বৃদ্ধাশ্রমের বদ্ধ ঘরেই কাটে।
মকবুল হোসেন জানান, সন্তানরা আট বিঘা জমি রেজিস্ট্রি করে নেওয়ার পর বাড়ি থেকে বের করে দেয়। এর পর বিভিন্ন হোটেলে কাজ করতেন। বয়সের ভারে হোটেলে কাজ করতে না পেরে এখানে সেখানে থাকতে শুরু করেন। তার অবস্থা দেখে স্ত্রীও অন্যত্র চলে গেছেন। তারপর চলে আসেন এই বৃদ্ধাশ্রমে। চার বছরের বেশি সময় ধরে মকবুল হোসেন এই বৃদ্ধাশ্রমে থাকলেও সন্তানরা খোঁজ নেন না। ঈদেও একবার দেখতে আসেনি।’ ৪ মেয়ে, ৩ ছেলে রয়েছে তার। সবার বিয়ে দিয়েছেন তিনি। মকবুল হোসেনের বাড়ি নাটোরের দুড়দুড়ি এলাকায়।
মকবুল হোসেনের পাশের কক্ষটি নারীদের। সেখানে ৫০জন নারী শুয়ে-বসে ছিলেন। তাঁদের একজন নাটোরের হাসিনা বেগম। পরিবারের সঙ্গে কাটানোর সময়ের কথা মনে করে আফসোসে হাসিনা বলেন,স্বামী ও ছেলে- মেয়েকে নিয়ে ছিল তার সংসার। স্বামী মারা যাওয়ার পর একা হয়ে পড়েন তিনি। সরেরহাট গ্রামের শান্তি বেগম বলেন, যখন পরিবারে ছিলাম, তখন কত কী আয়োজন নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হতো। সেই আনন্দ এখন আর নেই।’ তিনি বলেন, অনেক বছর ছেলে-মেয়েকে দেখি না। তাঁরাও খোঁজ নেন না।
এই প্রবীণদের একসময় নিজের সংসার ছিল। এখনো অনেকের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি আছে। কিন্তু সেই সংসারে তাঁদের ঠাঁই হয়নি। এখানে আসার পর ছেলেমেয়ের আর সময় হয়নি খোঁজ নেওয়ার। এখন বৃদ্ধাশ্রমের কর্তব্যরত ব্যক্তিদের ওপরেই তাঁরা পুরোপুরি নির্ভরশীল।
শিশু-বৃদ্ধরা ডা. সামসুদ্দিন কে বাবা ও তার স্ত্রী মেহেরুন্নেসাকে আম্মা বলে ডাকেন। শত অনাথের বাবা মা এই দম্পতি জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বাবা মায়ের স্নেহে বুক দিয়ে আগলে রাখতে চান এসব শিশু-বৃদ্ধদের। শমেস-মেহেরুন ম্পত্তির দুই ছেলে ও তিন মেয়ে রয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগে গঠিত এ আশ্রয়কেন্দ্রের প্রধান তত্ত্বাবধানকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন শমেস-মেহেরুন্নেছা দম্পতি। তারা বলেন, ‘আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী, শিশু-বৃদ্ধদের নিয়ে আনন্দ ভাগাভাগি করেছি। আমাদেরও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমাদের ব্যক্তিগত সামর্থ্যের সঙ্গে বিভিন্নজনের সহায়তায় চলছে প্রতিষ্ঠানটি।
মমতাজ-আজিজ বৃদ্ধাশ্রমের উদ্যোক্তা ফকরুল করিম, প্রতিমাসে অনুদান দেন ১লক্ষ ২৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে খাদ্য বাবদ ১লক্ষ টাকা আর ঔষধ ক্রয় বাবদ ২৫ হাজার টাকা। ২০২১-২২ অর্থ বছরে এতিমখানার শিশুদের জন্য সমাজ কল্যাণ মন্ত্রনালয় থেকে ১০০ জনের বরাদ্দ পেয়েছেন। প্রতিমাসে মাথাপিছু ২ হাজার টাকা। সব মিলে মাসিক খরচ হয় ৪ থেকে সাড়ে ৪ লক্ষ টাকা। বছরে যার পরিমান দাড়ায় ৭২ লক্ষ টাকা। সরকারি অনুদান পাওয়া যায় ২৪ লক্ষ টাকা আর বেসরকারি অনুদান আসে ১২ লক্ষ টাকা। প্রাপ্ত এই অনুদান পর্যাপ্ত নয় বললেন ডা.শামসুদ্দিন।
‘সরের হাট কল্যাণী শিশু সদন’ ও মমতাজ আজিজ বৃদ্ধাশ্রমটি রাজশাহীর বাঘা উপজেলার সরেরহাট গ্রামে অবস্থিত। জেলা ও উপজেলার একেবারে শেষ মাথায় গ্রামটির অবস্থান। এই গ্রামের তেমন কোন সুখ্যাতি নেই। একজন মানুষের অমানুষিক শ্রমের ফসল হিসাবে যার পরিচিতি পেয়েছে দেশজুড়ে। সাদা মনের মানুষ হিসাবে পদক পেয়েছেন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান সমেশ ডাক্তার। সরেরহাটের পাশের গ্রাম ব্রাম্মন ডাঙ্গার বাসিন্দা তিনি।
অনাদরে-অবহেলায় অনাথ ছেলেরা যখন রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিল, তা দেখে তাদের খাওয়া পরা, চিকিৎসাসহ পূর্ণবাসনের বিষয়টি দিন দিন বড় হতে থাকে তার। মানবিক বোধে উজ্জীবিত হয়েই কাঁধে তুলে নেন এতিমদের দ্বায়িত্ব ।
১৯৮৪ সালে স্ত্রী মেহেরুন্নেছাকে বুঝিয়ে তাকে দেওয়া মহরনা স্বত্ব দিয়ে ১২শতাংশ জমি কিনে রাজশাহী শহর থেকে ৪৮ কিলোমিটার পূর্বে পদ্মা নদীর তীর ঘেঁষে স্থানীয় জনগনের আর্থিক সাহায্যে ও নিজের প্রচেষ্টায় সরেরহাট গ্রামে ডা. শামসুদ্দিন সরকার গড়ে তুলেন একটি এতিম খানা। সে সময় এতিমদের সংখ্যা ছিল ৫৬ জন। বর্তমানে মোট জমির পরিমান .৩২ শাতাংশ। এখান থেকে বড় হয়ে অনেকই বিভিন্ন পেশায় কর্ম জীবিকা নির্বাহ করছেন।