আমার স্মৃতিতে পাবনায় বঙ্গবন্ধু

শেয়ার করুন

॥ বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. স. ম.আব্দুর রহিম পাকন ॥
আবহমান বাংলার চিরকালের সৌন্দর্য, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু বাঙ্গালিরই নয় সমগ্র পৃথিবীর অহংকার। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। এই মহান নেতা ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। বাঙালি জাতির হাজার বছরের আশীর্বাদ হয়ে যিনি টুঙ্গিপাড়ার পবিত্র মাটিকে ধন্য করেছিলেন তেমনি পরাধীন বাঙালি জাতিকে মুক্ত করার জন্য বঙ্গবন্ধু জন্ম গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর জন্ম না হলে লাল-সবুজের পতাকা এবং বাংলাদেশ জন্ম লাভ করতো না। এটা সারা বিশ্ব এবং সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত। বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়েছিল বলেই আমরা একটি স্বাধীন পতাকা, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং একটি স্বাধীন জাতির পবিত্র সংবিধান পেয়েছি।

হে পিতা মুজিব তোমার স্বপ্ন ছিল বাঙালি জাতিকে পশ্চিমা সামরিক জান্তা ও স্বৈরশাসকদের হাত থেকে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাঙালিকে মুক্ত করা, মুক্তির গান এবং বাঙ্গালীদের স্বপ্ন ছিল বিশ্বের মানচিত্রে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয়। মহান স্রষ্টা তোমাকে এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন একজন মুক্তির দূত হিসেবে। তুমি ছিলে শোষিত, নিপীড়িত, বঞ্চিত মানুষের কণ্ঠস্বর। বিশ্ব দরবারে তোমার কণ্ঠস্বরে উচ্চারিত হয়েছিল

“বিশ্ব দুই শিবিরে বিভক্ত- শোষক আর শোষিত। আমি শোষিতের পক্ষে”।

বিশ্ববাসী তোমাকে শোষিতের পক্ষে একজন যোগ্য নেতা ও নেতৃত্বদানকারী প্রতিনিধি হিসাবে স্থান করে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু এমন একজন নেতা যিনি শুধু বাঙালি জাতিকে মুক্তি দেননি, শোষিত-বঞ্চিত মানুষের মুক্তির পথ দেখিয়েছেন সারা বিশ্বকে। তাইতো কিউবার প্রেসিডেন্ট ফ্রিদেল কাস্টার মুখে উচ্চারিত হয়েছিল,

“আমি হিমালয় দেখি নাই কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমানকে দেখেছি।”

বঙ্গবন্ধু ছিলেন বাংলার প্রতিটি মানুষের হৃদয়ে এক অবিনাশী চেতনা। এই চেতনা কখনোই মুছে ফেলা যাবে না। বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে কখনো নিরাশ করেননি। তিনি তাঁর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতা দিয়ে ধীরে ধীরে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্থান করে দিয়েছেন।

আমার স্মৃতিতেও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সমুজ্জ্বল হয়ে আছেন। এই স্মৃতি সদাই জাগ্রত। আমার জীবনে পাবনায় বঙ্গবন্ধুর বিচিত্র স্মৃতি চিত্রিত হয়ে আছে চিরকালের জন্যে। এটা শুধু আমার মনে ও মননে। ছবির ভাষায় কিংবা রঙে বা আলোকচিত্রে এর ব্যাখ্যা হয়তো সুস্পষ্ট নয়, তবুও এটা বিন্দুর বুকে সিন্ধুর ছায়াপাত। যা আমি আঁকড়ে ধরে আছি বছরের পর বছর।

স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে (১৯৭২-১৯৭৫) আমি পাবনা জেলা ছাত্রলীগের পর্যায়ক্রমে ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক ও সাধারণ সম্পাদক। তখন জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপ্পু। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় ১৩ বার কয়েকবার পাবনায় এসেছেন। পাবনায় তাঁর গুণগ্রাহী, দলীয় নেতাকর্মী এবং ভক্তবৃন্দের অভাব ছিল না।

প্রথম দেখা ঃ
১৯৬৬ সালের ৭ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে আমি প্রথম দেখি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন ছয় দফাকে জনপ্রিয় করে তোলার জন্য বাংলাদেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে উল্কার মত ছুটে বেড়াচ্ছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় পাবনাতেও তিনি পদার্পণ করেন। পাবনায় এসেই তিনি তৎকালীন জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রব বগা মিয়ার বাসায় দুপুরের খাওয়া শেষ করে টাউন হল ময়দানে ছয় দফা বিশ্লেষণ করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। টাউন হল ময়দানে বিশাল জনসভায় আমি ছয় দফার বিষয় বুঝে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়লাম। বঙ্গবন্ধুর আদর্শে অনুপ্রানিত হয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হবার অনুপ্রেরণা পাই। সেই আদর্শ এখনো লালন করে যাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুকে সেই প্রথম দেখার অনুভূতি এখনো ভুলতে পারি নাই।

১৯৬৭ সালের এর গণআন্দোলন এবং ১৯৬৮-১৯৬৯ এর ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী সামরিক পাকিস্তানী শাসকরা বঙ্গবন্ধুর নামে আগড়তলা মিথ্যা ও ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে জাতীয় নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। যেটা ছিল বাঙ্গালীর জাতীর জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচন। এই নির্বাচন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইতিহাসের বিশেষ ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য। এই আন্দোলনে পাবনার আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ ও সর্বস্তরের জনগন বিশেষ ভূমিকা রাখে যার সঙ্গে আমিও প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম।

দ্বিতীয় দেখা ঃ
১৯৭০ সালে ৮ই মার্চের নির্বাচনী প্রচারনায় বঙ্গবন্ধু পাবনায় আসেন। সে সময়ে আমি পাবনা জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক ছিলাম। বঙ্গবন্ধু নির্বাচনী প্রচারনায় তাঁর সাথী হিসেবে ছিলেন কেন্দ্রীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী, তাজউদ্দিন আহমেদ সহ আরও কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে নিয়ে দাশুড়িয়া, টেবুনিয়া, এডওয়ার্ড কলেজ গেট হয়ে পাবনায় প্রবেশ করেন। সে সময়ে এডওয়ার্ড কলেজ গেটে আওয়ামীলীগ বিরোধীরা বাধা প্রদানের চেষ্টা করে সফল হতে পারেনি।

এই বাধা অতিক্রম করে সার্কিট হাউজে দুপুরে খাবার বিরতি দেন। এখানে ফুলের মালা দিয়ে তাঁকে বরণ করি এবং পায়ে হাত দিয়ে সালাম করার সুযোগ পাই। তিনি আমাদের মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করেন এবং বলেন ‘আমার কোটটা অপরিস্কার হয়েছে এটাকে পরিস্কার করা দরকার’। তখন আমি ও চুপ্পু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গায়ের কোটটি নিয়ে শহরের একমাত্র ‘রুচিরা ড্রাই ক্লিনার্সে’ এ যাই যার মেশিন ছিল বিসিক শিল্প নগরীতে। কিন্তু শুক্রবার হওয়াতে ‘ড্রাই ক্লিনার্স’এর দোকান বন্ধ ছিল। পরে বিসিক শিল্প নগরীতে যেয়ে কোটটা পরিস্কার করে নিয়ে বঙ্গবন্ধুর নিকট পৌঁছাই। তিনি আমাদের মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন ‘তোদের দ্বারাই বাঙ্গালি জাতি বৈষম্য থেকে মুক্ত হতে পারে’।

বিরতির পর বেড়া কাশীনাথপুরে নির্বাচনী জনসভার উদ্দ্যেশে তাঁর সফর সঙ্গী হিসেবে পাবনা জেলা আওয়ামীলীগের সঙ্গে আমরাও ছিলাম। এই জনসভায় এসে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ এবং আরিচা নগরবাড়ি সেতু নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসনা প্রধানমন্ত্রী হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বাস্তবায়ন করার জন্য নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। আমি আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থায় কাজ করার সুবাদে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণে বিভিন্নভাবে সহযোগীতা করতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি।

তৃতীয় দেখা ঃ
১৯৭০ সালের ২২ ডিসেম্বর পাবনা বাসীর জন্য একটি শোকাবহ দিন। এই দিনে প্রাদেশিক পরিষদের সদ্য নির্বাচিত (সাঁথিয়া-বেড়া) সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য আহম্মদ রফিক নকশালীদের হাতে নিহত হন। ১৯৭০ সালের ২৫ ডিসেম্বরে এই শোকাবহ হৃদয় নিয়ে বঙ্গবন্ধু পাবনায় এসে আহম্মদ রফিকের পরিবারের সাথে দেখা করে সমবেদনা জ্ঞাপন করেন এবং আরিফপুর গোরস্থানে গিয়ে কবর জিয়ারত করে পুলিশ লাইন ময়দানে শোক সভায় অংশগ্রহণ করেন। সভামঞ্চে ছাত্রনেতাদের মধ্যে আমিও ছিলাম। সভামঞ্চ থেকে নামার সময় বঙ্গবন্ধু আমাদের উদ্দ্যেশে বলেন, “তোরা সব প্রস্তুত থাকবি। সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে দেশের কল্যাণে কাজ করতে হবে”।

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহবানে আমি এবং আমার সহোদর দুইভাই মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করি। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধশেষে ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে নতুন একটি দেশ হিসেবে স্থান পায়।

চতুর্থ দেখাঃ
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী বঙ্গবন্ধু স্বৈরাচারী সামরিক পাকিস্তানী শাসকের কবল থেকে মুক্ত হয়ে বাংলার মাটিতে পদার্পন করেন। ১৯৭২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারী পাবনা সিরাজগঞ্জের মানুষদের বন্যার হাত থেকে রক্ষার জন্য নগরবাড়িতে ‘মুজিব বাঁধ’ উদ্বোধন করতে আসেন।

পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা ফজলুল হক মন্টু এবং আমি সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ছাত্রলীগ সহ আওয়ামীলীগের অন্যান্য নেতাদের সাথে মঞ্চে উপস্থিত ছিলাম। এই বাঁধ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে জেলা আওয়ামীলীগের সিদ্ধান্ত মোতাবেক বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপ্পু মানপত্র পাঠ করেন। ‘মুজিব বাঁধ’ উদ্বোধন শেষে বঙ্গবন্ধু পাবনার বনমালী ইনন্সটিটিউটে এক নাগরিক সম্বোর্ধনায় যোগ দেন। এই অনুষ্ঠানে আমি সহ পাবনার অন্যান্য ছাত্র নেত্রীবৃন্দ উপস্থিত থেকে তাঁকে ফুলের শুভেচ্ছা জানানো হয়।

পঞ্চম দেখাঃ
১৯৭২ সালে ঢাকা রমনা পার্কে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন শেষে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা পাবনা নবনির্বাচিত কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে মিন্টু রোডে বর্তমান রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে জাতীর পিতার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাত করতে যাই। যাবার পর বঙ্গবন্ধুর নিকট আমরা আবেদন জানাই যে, মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের যে সকল কর্মকর্তাগন মহান মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতা করেছে তাদেরকে প্রশাসনিক কার্যক্রম থেকে সরিয়ে দেবার জন্য। তখন বঙ্গবন্ধু পিতৃতম নিবিড় ও নিখাদ ভালোবাসায় প্রত্যুত্তরে জানালেন যে, “তোমরা মুক্তিযুদ্ধ সহ সকল আন্দোলনে দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করছো। তোমাদের মত দেশপ্রেমিক সন্তানই এই দেশে দরকার। তোমাদের এখন দায়িত্ব স্ব স্ব প্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষায় আত্মনিয়োগ ও দেশের কল্যাণে কাজ করা”।
ষষ্ঠ দেখাঃ
১৯৭৩ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারী তখন আমি পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বপালন করছিলাম। পাবনায় বঙ্গবন্ধুর সবচেয়ে প্রিয়জন বলে খ্যাত আব্দুর রব বগা মিয়া নির্বাচনী প্রচারনা করতে বর্তমান বিআরটিসি গ্যারেজের সামনে সড়ক দূর্ঘটনায় মারাত্মক ভাবে আহত হন এবং পাবনা সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

তিনি বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পাবনা সদর আসন থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন। এ সময়ে বঙ্গবন্ধুর সভাপতিত্বে নাটোরে উত্তরা গণভবনে মন্ত্রী পরিষদের সভা চলছিলো। আব্দুর রব বগা মিয়ার মৃত্যু সংবাদ পেয়ে নাটোর উত্তরা গণভবনে মন্ত্রী পরিষদের সভা স্থগিত করে তিনি পাবনায় চলে আসেন। বঙ্গবন্ধু আব্দুর রব বগা মিয়ার মরদেহ দেখে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছিলেন। এ যেন স্বজন হারানো কান্না। এ সময় বঙ্গবন্ধুর পাশে আমি সহ তৎকালীন পাবনা জেলা আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ ছিলাম।

সপ্তম দেখাঃ
১৯৭৪ সালের ৪ঠা এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক নির্মম ছাত্র হত্যাকান্ড ঘটে। যেটা ‘সেভেন মার্ডার’ নামে পরিচিত। এই জঘন্য হত্যাকান্ডে নিহত হয়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেতা নাজমুল হক কোহিনুর সহ আরও ৬ জন। তদন্ত সাপেক্ষে এই হত্যা মামলার প্রধান আসামী হিসেবে সনাক্ত হয় তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শফিউল আলম প্রধান।

তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শহীদ মনসুর আলী এবং প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নির্দেশক্রমে শফিউল আলম প্রধান সহ অন্যান্য সকল আসামীদের গ্রেফাতারের নির্দেশ প্রদান করেন। এই নির্দেশের পর পরই শফিউল আলম প্রধান সহ সকল আসামীদের গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পরবর্তীতে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সে সময়ের সভাপতি মনিরুল হক চৌধুরী প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এই গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানান। এই প্রতিবাদে সমগ্র বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলা থেকে প্রতিবাদ হলেও পাবনা জেলা ছাত্রলীগ এতে সাড়া দেয় দেয়নি।

পাবনা জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপ্পু এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক আমি বীর মুক্তিযোদ্ধা আ স ম আব্দুর রহিম পাকন প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে তৎকালীন সরকারের সিদ্ধান্তের সাথে একাত্ততা প্রকাশ করি। এই সমর্থন জানানোর কারণে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ আমাদের কমিটি বাতিল করে দেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, এই গ্রেফতারের সমর্থন না জানানোর কারণে তৎকালীন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ রাজশাহী মহানগর শাখার সভাপতি বর্তমান বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কার্যকরী পরিষদের সদস্য নুরুল ইসলাম ঠান্টুকেও তার পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপ্পু এবং আমি সঙ্গে সঙ্গে তৎকালীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম মোহাম্মদ নাসিমের মাধ্যমে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শহীদ এম মনসুর আলীর সঙ্গে যোগাযোগ করার পর তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করার সুযোগ করে দেন। আমি এবং চুপ্পু সহ জেলা ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ মিন্টু রোডে অবস্থিত তৎকালীন গণভবনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু জাতির পিতা শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে দেখা করি এবং তাঁকে বিস্তারিত অবগত করার পর তিঁনি আমাদেরকে বলেন “দেশের মধ্যে বিভিন্ন রকম ষড়যন্ত্র চলছে তোমাদেরকে সদা প্রস্তুত থাকতে হবে”। তিঁনি জানতে চান পাবনা জেলা ছাত্রলীগ বর্তমানে কাদের নিয়ন্ত্রনে’। আমরা বলি সেটা এখনও আমাদের নিয়ন্ত্রনেই আছে। তখন বঙ্গবন্ধু বলেন “তোমরা ন্যয়ের পথে আছো তোমরা এগিয়ে যাও”। এরপর আমরা বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পাবনায় ফিরে আসি এবং আরও উদ্বুদ্ধ হয়ে সাংগঠনিক কাজে আত্মনিয়োগের মাধ্যমে স্বাভাবিক ভাবে কর্মকান্ড করতে থাকি।

অষ্টম ও শেষ দেখা ঃ
১৯৭৪ সালে সারাদেশে বন্যায় প্লাবিত হলে পাবনা জেলা আওয়ামীলীগ ও ছাত্রলীগের পক্ষ থেকে আমরা ত্রাণ সংগ্রহ কার্যক্রমে অংশ নেই। পাবনা থেকে সংগৃহীত ত্রাণের অর্থ নিয়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর ত্রাণ তহবিলে জমা দেবার জন্য ঢাকা যাই। গণভবনে ত্রাণের চেক হস্তান্তর অনুষ্ঠিত হয়। আমরা জাতির পিতার ঘনিষ্ঠ, পাবনার কৃতি সন্তান শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী নেতৃত্বে গণভবনে বঙ্গবন্ধুর হাতে চেক হস্তান্তর করি। এই চেক হস্তান্তর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পাবনা জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি মরহুম আবু তালেব খন্দকার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মরহুম মোহাম্মদ নাসিম, সাহাবুদ্দিন চুপ্পু, আমি ও জেলা আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ। এটাই ছিল আমার বঙ্গবন্ধুর সাথে শেষ সাক্ষাত।

পাবনায় বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি অনন্য। এই স্মৃতির মালায় ভীড় করে আছে টুকরো টুকরো অনেক গল্প। যা আজ ইতিহাস। বঙ্গবন্ধু পাবনা সফরে আসলে অনেক সময় তৎকালীণ পাবনা জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মরহুম আমজাদ হোসেন’এর বাড়িতে রাত্রি যাপন করতেন এবং যাদের বাড়িতে তিনি আহার করতেন তারা হলেন সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রব বগা মিয়া ও পাবনার বিশিষ্ট বিড়ি ব্যবসায়ী মরহুম হোসেন খাঁ (হোসেন বিড়ি ওয়ালা) অন্যতম।

পাবনার লক্ষী মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টি ছিল বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত প্রিয়। লক্ষী মিষ্টান্ন ভান্ডারের কর্ণধার ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একজন ভক্ত। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন ১৯৯৪ সালে ২৩ সেপ্টেম্বর বঙ্গবন্ধুর কন্যা তৎকালীন বিরোধী দলের নেত্রী দেশরতœ শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে পাবনার ঈশ্বরর্দীতে ট্রেনে হামলা করা হয়। আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দ মানব প্রাচীর করে তাকে রক্ষা করেন এবং লক্ষী মিষ্টান্ন ভান্ডারের মালিকানাধীন বাদল পরিবহনের গাড়িতে করে নাটোর নিরাপদ স্থানে পৌঁছানোর সহযোগীতা করি।

আমাদের রাজনীতি উৎসর্গ হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মানবপ্রেম ও দেশপ্রেম দেখে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সেই বজ্রকন্ঠ ধারণ করেই আমরা মুক্তিযুদ্ধে যাই। ফিরে এসে দেশগঠনের কাজ শুরু করি। এ কারণে আজও শয়নে স্বপনে জাগরণে বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিতে অনুপ্রানিত হই অসংখ্যবার।

লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. স. ম.আব্দুর রহিম পাকন
ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (১৯৭৩-৭৫) ও বর্তমান জেলা আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *