॥ ড. মো. মনছুর আলম ॥
নজরুল ইসলাম তাঁর সৃষ্ট সাহিত্যকর্মে হিন্দু-মুসলমানের মিশ্র ঐহিহ্যের পরিচর্যা করেছেন। কবিতা ও গানে তিনি এই মিশ্র ঐতিহ্য চেতনাবশত প্রচলিত বাংলা ছন্দরীতি ছাড়াও অনেক সংস্কৃত ও আরবি ছন্দ ব্যবহার করেছেন। অধুনা বাংলা ভাষাকে মুসলমান সমাজের মাতৃভাষার সম্মান প্রদান করে ভাষার উৎকর্ষ সাধন করেছেন। তৎকালে প্রায় সকল বাঙালিই মাতৃভাষা চর্চায় আগ্রহী, পঠন-পাঠনে তরুণেরা আরো বেশি আগ্রহী দেখে নজরুল ইসলাম অত্যন্ত আনন্দিত হয়েছেন। তিনি বাংলা সাহিতে মুসলিম লেখকদেরকে স্থায়ী আসন দখল করার আহ্বান জানিয়ে ভিভিন্ন সভা-সেমিনার করেছেন। তাঁর ভাষায়- জড়, প্রাণহীন ও নির্জীব সাহিত্য যেমন সমাজের কোনো উপকারে আসেনা তেমনি তা স্থায়ী সাহিত্যেরও সৃষ্টি হয় না। এর সাথে সাথে তিনি ধর্মবিদ্বেষ, জাতি বিদ্বেষ পরিহার করে এবং ইসলামের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে অক্ষুণ্ণ রেখে সাহিত্য রচনার জন্য সাহিত্যিকদের আহ্বান জানান। এছাড়া তিনি সাহিত্যে সর্বজনীনতা আনতেও সমকালীন সাহিত্যিকদের আহ্বান জানান। তবে সে সর্বজনীনতা হবে নিজের জাতীয় ও দেশীয় বিশেষত্বকে না এড়িয়ে না হারিয়ে। (যুগবাণী, ‘বাংলা সাহিত্যে মুসলমান’)।
নজরুল ইসলাম মনে করেন, মুসলমান সভ্যতা-সংস্কৃতি মূলত আরবি, ফারসি, উর্দু-এ তিন ভাষাতেই বন্দী। প্রতিবেশি হিন্দু সমাজ তাদের সংস্কৃতি, সভ্যতা, শাস্ত্রগ্রন্থসমূহ বাংলায় অনুবাদ করার ফলে মুসলমানগণ তাদের সভ্যতার সাথে সহজে পরিচিত হতে পেরেছে। অথচ বিশ্ব সভ্যতায় মুসলমানদের দানের মহিমা সম্পর্কে হিন্দুরা অজ্ঞ, এমনকি অনেক মুসলমানও অন্ধকারে রয়েছে। অথচ বাংলার উচ্চশ্রেণি এবং কবি-সাহিত্যিক যাঁরা ঐ তিন ভাষাতে পারদর্শী তারাও ইসলামি গ্রন্থগুলো অনুবাদের মাধ্যমে বাংলা ভাষা-ভাষী জনগোষ্ঠিকে তা অবহিত করতে উদাসীন। তাঁর ভাষায়, “—- তাই আপনাদের অনুরোধ করতে এসেছি এবং আপনাদের মারফতে বাঙলার সকল চিন্তাশীল মুসলমানদেরও অনুরোধ করছি, আপনাদের শক্তি আছে, অর্থ আছে- যদি পারেন মাতৃ ভাষায় আপনাদের সাহিত্য- জ্ঞান-বিজ্ঞান-ইতিহাস সভ্যতার অনুবাদ ও অনুশীলনের কেন্দ্রভূমি যেখানে হোক প্রতিষ্ঠা করুন। তা না পারলে অনর্থক ‘ধর্ম্ম ধর্ম্ম বলে’ ‘ইসলাম বলে’ চিৎকার করবেন না।”(‘মুসলিম সংস্কৃতির চর্চা’, ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম এডুকেশন সোসাইটির প্রতিষ্ঠা উপলক্ষে সভাপতি হিসেবে কবির ভাষণ)।
কাজী নজরুল ইসলাম কেবল চিন্তা ও ভাবনায়ই নয়, তিনি বাংলা ভাষাকে ইসলামী ঐতিহ্য আনয়নে অসংখ্য আরবি, ফারসি শব্দ অসাধারণ শিল্প-কুশলতায় প্রয়োগ করেছেন। এভাবে সংস্কৃত শব্দ প্রভাবিত বাংলা ভাষার গতানুগতিক রূপ বদলিয়ে বাংলা ভাষাকে তিনি করেছিলেন সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী। আমরা জানি বাংলা সঙ্গীতের প্রায় সবকটি ধারার পরিচর্যা ও পরিপুষ্টি, বাংলা গানকে উত্তর ভারতীয় রাগ সঙ্গীতের দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থান এবং লোকসঙ্গীতাশ্রয়ী বাংলা গানকে উপমহাদেশের বৃহত্তর মার্গসঙ্গীতের ঐতিহ্যের সঙ্গে সংযুক্তি নজরুল ইসলামের মৌলিক সঙ্গীত প্রতিভার পরিচায়ক।
নজরুল সঙ্গীত বাংলা সঙ্গীতের অনুবিশ্ব, তদুপরি উত্তর ভারতীয় রাগসঙ্গীতের বঙ্গীয় সংস্করণ। বাণী ও সুরের বৈচিত্র্যে নজরুল ইসলাম বাংলা গানকে যথার্থ আধুনিক সঙ্গীতে রূপান্তরিত করেন। এছাড়া মুসলিম ইতিহাস-ঐতিহ্যও সঙ্গীতের মাধ্যমে ফুটে তোলেন। তিনি কিছু গানে আরবি, ইরানি ও তুর্কি সঙ্গীতের সুর সংযোজন করেন। ফলে মুসলিম ইতিহাস ঐতিহ্য আশ্রয়ী এসকল ইসলামি গান ও গজলের ছন্দ, সুর ঝঙ্কার স্পন্দিত হলো শ্রোতাদের হৃদয়ে। আব্বাস উদ্দিনের কন্ঠে নজরুলের গানের যে ব্যঞ্জনা সৃষ্টি হলো অধিকাংশ মানুষ তা হৃদয়ের গভীরে স্থান দিল। মুসলমানগণ এ সকল সঙ্গীতে খুঁজে পেল তার আপন সত্ত্ব ও ঐতিহ্য। পেল তৌহিদের আলোকে জেগে উঠার সঞ্জীবনী মন্ত্র। যেমন-
‘দিকে দিকে পুন জ্বলিয়া উঠছে
দ্বীন-ই-ইসলামী লাল মশাল।
ওরে বে-খবর, তুইও ওঠ জেগে
তুইও তোর প্রাণ প্রদীপ জ্বাল।।
কিংবা, আল্লাহতে যার পূর্ণ ঈমান কোথা সে মুসলমান।’
কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গীত সমকাল মুসলিম মানসে কি পরিমাণ বিদ্যুৎ তরঙ্গের সৃষ্টি করেছিল তা আব্বাস উদ্দীন আহমদ তাঁর আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন “এর পর কাজী দা লিখে চললেন ইসলামী গান। আল্লা-রাসুূলর গান গেয়ে বাংলার মুসলমানের ঘরে ঘরে জাগল এক নব উম্মাদনা। যারা গান শুনলে কানে আঙ্গুল দিত তাদের কানে গেল, ‘আল্লা নামের বীজ বুনেছি’, ‘নাম মোহাম্মাদ বোল রে মন, নাম আহমদ বোল’, কান থেকে হাত ছেড়ে তন্ময় হয়ে শুনল”। নজরুল বিশ্বাস করতেন তৌহিদের বাণী ও মানবতার কলনাদে মুখরিত সঙ্গীত বাংলার মুসলমানদের নির্জীব প্রাণকে উদ্দাম করে তুলবে এতে কোন সন্দেহ নেই।
নজরুল ইসলামের কবি প্রতিভা ছিল বিচিত্রধর্মী তিনি একাধারে কবি, গীতিকার, সুরকার, বাদক, গাল্পিক, ঔপন্যাসিক, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, গায়ক ও অভিনেতা। বাংলা ও ইংরেজি ভাষা ছাড়াও তিনি আরবি, ফারসি, উর্দু, সংস্কৃত ও হিন্দি ভাষাতেও দক্ষতা অর্জন করেন। এজন্যই তাঁর কবিতায় একদিকে যেমন শেলী, বায়রণ, কিট্স, সুইবার্ণ ও হুইটম্যানের আদল লক্ষ্য করা যায়, তেমনি প্রভাব দেখা যায় আল্লামা রুমী, হাফিজ, উমার খইয়াম ও ইকবালের। তাঁর হাতেই বাংলা ভাষা পেয়েছে প্রাণ বাংলা সাহিত্য হয়েছে সুসমৃদ্ধ
নজরুল ইসলাম ২৫ মে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে (১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জৈষ্ঠ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সাম্য, দ্রোহ, প্রেম-ভালোবাসার কবি, বাংলা গানের বুলবুল আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২৪ তম জন্ম বার্ষিকীতে জানাই কবির প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা ও অন্তরের গহিন হতে ভালোবাসা। [ লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক; সভাপতি, সাহিত্য ও বিতর্ক ক্লাব পাবনা।]