॥ বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.স.ম আব্দুর রহিম পাকন ॥
বাঙালি জাতি চির দুর্বার, চির দুর্দম। যুগে যুগে তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকেছে। শক্তিবলে অসম হলেও তারা ব্রিটিশদের সামনে কভু মাথা নত করেনি। পাকিস্তানি শোষক গোষ্ঠীর দুঃশাসন, অত্যাচারে জর্জরিত বাঙালি দৃঢ়কন্ঠে অন্যায়ের প্রতিবাদ জানিয়েছে। ৫২’র হার না মানা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছে নিজেদের মাতৃভাষার অধিকার। ধীরে ধীরে দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়ে গেছে স্বাধিকার আন্দোলনের দিক। ১৯৬৬ সালের ৭ই জুন বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবীতে সারা দেশে হরতাল পালিত হয়। ৭ জুন তাই ‘ছয় দফা দিবস’।
ঐতিহাসিক ০৭ জুন বাঙালি জাতির মুক্তি সনদ ছয় দফা দিবস আজকের এই দিনে বিন¤্র শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট ঘাতকদরে হাতে নিহত হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি ছয় দফার প্রর্বতক জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছাসহ তাঁর পরিবারের সকল সদস্যবৃন্দকে। আরও স্মরণ করছি ১৯৭৫ এর ৩রা নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিহত বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর জাতীয় চার নেতা শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ, শহীদ এম মনসুর আলী ও শহীদ এ এইচ এম কামরুজ্জামানসহ ছয় দফা আন্দোলন ও স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে যে সমস্ত বীর সৈনিকেরা শহীদ হয়েছেন তাঁদের প্রতি জানাই বিন¤্র শ্রদ্ধা। পরম করুণাময় আল্লাহ পাকের কাছে শ্রদ্ধাভরে কৃতজ্ঞতা জানাই জাতির পিতার দুই সুযোগ্য কন্যাকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য।
১৯৪৭ সালের ১৪ ই আগস্ট দ্বিজাতীয় ভিত্তিতে জন্ম নিয়েছিল পাকিস্তান নামে একটি রাষ্ট্র যে রাষ্ট্রের ছিল দুইটি প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান। এই দুই প্রদেশের মধ্যে যে শুধু দূরত্ব বৈষম্য ছিল তা কিন্তু নয়। পাকিস্তান জন্মলাভের পর থেকেই চলছিল পূর্ব পাকিস্তানের উপর বৈষম্যমূলক আচরণ এবং প্রথম আঘাত আসে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে উপেক্ষা করে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা না করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেন।
পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলা জনগণ তখন থেকেই বিদ্রোহ শুরু করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালে ৫ ও ৬ ই ফেব্রুয়ারি লাহোরে সম্মিলিত বিরোধী দলসমূহের এক কনভেনশনে বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই কনভেনশনে অংশগ্রহণ করে বাংলার জনগণকে বৈষম্যের হাত থেকে রক্ষাকল্পে ৫ই ফেব্রুয়ারি ৬ দফা দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু উক্ত কনভেনশনের সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ছয় দফা দাবি নিয়ে আলোচনা করার অসম্মতি জানান এবং ৬ ই ফেব্রুয়ারি তৎকালীন অনেক জাতীয় পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করে সংবাদ পরিবেশন করেন বঙ্গবন্ধু এতে বিস্মিত ও মর্মাহত হন। তিনি উক্ত কনভেনশন বয়কট করেন এবং ১১ ই ফেব্রুয়ারি দেশে ফিরে এসে সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে এ বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন এবং ২০ শে ফেব্রুয়ারি আওয়ামীলীগের কমিটির সভা আহ্বান করেন। ঐ সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বঙ্গবন্ধুর পাশকৃত ৬ দফা সর্বসম্মতি ক্রমে অনুমোদিত হয় এবং দলীয় কর্মসূচি হিসাবে ৬ দফাকে গ্রহণ করা হয়।
১৯৬৬ সালের ১৮,১৯,২০ মার্চ মাসের অনুষ্ঠিতব্য বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের জাতীয় সম্মেলনে ৬ দফা দাবি সম্মিলিত ‘ছয় দফা’ প্রচার ও প্রকাশের জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ছয় সদস্য বিশিষ্ট ‘উপ-কমিটি গঠন এবং তাঁরই নামে ‘আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা কর্মসূচি শীর্ষক একটি পুস্তিকা মুদ্রিত ও প্রকাশিত করে তা নেতাকর্মীদের মধ্যে পুস্তকটি বিতরণ করলে নেতাকর্মীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া জাগায়। তারপর থেকেই বঙ্গবন্ধু ৬ দফা দাবিকে বাংলার জনগণের প্রাণের দাবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভের জন্য বাংলার মাঠে ঘাটে ৬ দফার ফেরিওয়ালা হয়ে প্রচারে নেমে পরেন এবং অতি অল্প সময়ের মধ্যে এই দাবিকে জনগণের দাবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করতে সমর্থ হন।
১৯৬৬ সালরে ৮ ই মে বঙ্গবন্ধুকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার পরবর্তীতে একদিকে চলছে বিচারের নামে প্রহসন আর অন্যদিকে বাংলার ছাত্র ও জনতা আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এই প্রহসন বিচার ও বঙ্গবন্ধুকে কারাগার থেকে মুক্ত করবার লক্ষ্যে রাজপথে নেমে আসে বাংলার ছাত্র-জনতা। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয় শ্রমজীবী মেহনতি মানুষের আন্দোলন। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন ৬ দফা দাবির পক্ষে দেশব্যাপী তীব্র গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়। এই দিনে আওয়মীলীগের ডাকা হরতালে টঙ্গী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জে পুলিশ ও ইপিআরের গুলিতে মনু মিয়া, শফিক, শামসুল হকসহ ১১ জন বাঙালি শহীদ হন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম গৌরবময় অধ্যায় হলো এই ৬ দফা আন্দোলনে নেতৃত্ব। ৬ দফার পক্ষে জনমত সংগঠিত করার লক্ষ্যে সারা বাংলায় গণসংযোগ শুরু করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ঐ সময় গণসংযোগকালে তাকে সিলেট, ময়মনসিংহ ও ঢাকায় বারবার গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৬ সালের প্রথম তিন মাসে তিনি ৮ বার গ্রেফতার হন।
১৯৬৬ সালের ৮ ই এপ্রিল পাবনা বাসী ও আমার (আ. স. ম. আব্দুর রহিম পাকন) জন্য একটি গৌরব উজ্জ্বল দিন। আমি সেই সময় পাবনা শহরে অবস্থিত আর এম একাডেমির সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। ঐ দিনে ৬ দফার ফেরিওয়ালা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার প্রণোদিত ৬ দফা দাবিকে পাবনার জনগণের মধ্যে প্রচারের (গণসংযোগ) লক্ষ্যে পাবনা টাউন হল ময়দানে এক বিশাল জনসভায় তার প্রণোদিত ৬ দফা কে ব্যাখ্যা করেন উক্ত জনসভায় সভাপতিত্ব করেন পাবনা জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মরহুম আমজাদ হোসেন ও সভা পরিচালনা করেন পাবনা জেলা আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম আব্দুর রব বগা মিয়া। তার সফরসঙ্গী ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের অন্যতম সহ-সভাপতি শহীদ এম মনসুর আলীসহ অন্যান্য জাতীয় নেতৃবৃন্দ। সেদিনের সেই জনসভায় বঙ্গবন্ধু তার প্রণোদিত ছয় দফা দাবি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পাবনার জনসম্মুখে বিশ্লেষণ করেন।
সেদিন আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই জনসভায় তার বক্তব্য শোনার এবং পাকিস্তানি বৈষম্যের বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রেরণা যোগাতে সহায়তা করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৭ থেকে আমি বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া ছাত্রলীগের একজন কর্মী হিসেবে নিজেকে জড়িয়ে ফেলি।
পাকিস্তানের সামরিক সরকার এই ছাত্র-জনতার ঢল দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে ১৯৬৯ সালের ২২ই ফেব্রুয়ারি বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রত্যাহার করে তাঁকে মুক্তি প্রদান করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁর দাবি থেকে সরে দাঁড়াননি তিনি বাংলার জনগণকে একত্রিত করে তাঁদরে প্রাণের দাবি ৬ দফা বাস্তবায়নে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন ।
এ আন্দোলনের মধ্য দিয়েই ১৯৬৯ এর গণঅভ্যূত্থান হয়। ৬ দফা আন্দোলনের মধ্য দিয়েই আওয়ামীলীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত হন। এরপর ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগ তথা বাঙালি জাতি বিপুল বিজয় পায়।
এই আন্দোলনের ফলশ্রুতি হিসেবে সত্তরের নির্বাচন এবং একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়।
৬ দফাতে কি ছিল :
১ : শাসনতান্ত্রিক কাঠামো ও রাষ্ট্রের প্রকৃত:
দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনি হতে হবে যেখানে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন ভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব। সরকার হবে পার্লামেন্ট ধরনের। আইন পরিষদের ক্ষমতা হবে সার্বভৌম এবং এই পরিষদেও নির্বাচিত হবে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসাধারনের সরাসরি ভোট।
২ : কেন্দ্রীয় সরকাররে ক্ষমতা :
কেন্দ্রীয় (ফেডারেল) সরকারের ক্ষমতা কেবলমাত্র দু’টি ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে- যথা, দেশরক্ষা ও বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট সকল বিষয়ে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির ক্ষমতা থাকবে নিরঙ্কুশ।
৩ : মুদ্রা বা অর্থ-সমন্ধীয় ক্ষমতা :
মুদ্রার ব্যাপারে নিম্নলিখিত দু’টোর যে কোন একটি প্রস্তাব প্রহণ করা চলতে পারে।
(ক) সমগ্র দেশের জন্য দু’টি পৃথক, অথচ অবাধে বিনিময়যাগ্য মুদ্রা চালু থাকবে।
অথবা
(খ) বর্তমান নিয়মে সমগ্র দেশের জন্যে কেবলমাত্র একটি মুদ্রাই চালু থাকতে পারে। তবে সেক্ষেত্রে শাসনতন্ত্রে এমন ফলপ্রসূ ব্যবস্থা রাখতে হবে যাতে করে পূর্ব। পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচারের পথ বন্ধ হয়। এক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং রিজার্ভেরও পত্তন করতে হবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক আর্থিক বা অর্থবিষয়ক নীতি প্রর্বতন করতে হবে ।
৪ : রাজস্ব, কর, বা শুল্ক সম্বন্ধীয় ক্ষমতা:
ফেডারেশনের অঙ্গ রাজ্যগুলির কর বা শুল্ক ধার্যের ব্যাপারে সার্বভৌম ক্ষমতা থাকবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কোনরূপ কর ধার্যের ক্ষমতা থাকবে না। তবে প্রয়োজনীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য অঙ্গ-রাষ্ট্রীয় রাজস্বের একটি অংশ কেন্দ্রীয় সরকারের প্রাপ্য হবে। অঙ্গ রাষ্ট্রগুলির সব রকমের করের শতকরা একই হারে আদায়কৃত অংশ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের তহবিল গঠিত হবে।
৫ : বৈদেশিক বাণিজ্য বিষয়ক ক্ষমতা:
(ক) ফেডারেশনভুক্ত প্রতিটি রাজ্যের বহির্বানিজ্যের পৃথক পৃথক হিসাব রক্ষা করতে হবে।
(খ) বহির্বানিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা অঙ্গ রাজ্যগুলির এখতিয়ারাধীন থাকবে
(গ) কেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা সমান হারে অথবা সর্বসম্মত কোন হারে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলিই মিটাবে।
(ঘ) অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলির মধ্যে দেশজ দ্রব্য চলাচলের ক্ষেত্রে শুল্ক বা করজাতীয় কোন রকম বাধা-নিষেধ থাকবে না।
(ঙ) শাসনতন্ত্রে অঙ্গ রাষ্ট্রগুলিকে বিদেশে নিজ নিজ বানিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণ এবং স্ব-স্বার্থে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদনের ক্ষমতা দিতে হবে।
৬ : আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠনের ক্ষমতা: আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্র রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্রে অঙ্গ-রাষ্ট্রগুলিকে স্বীয় কর্তৃত্বাধীনে আধা সামরিক বা আঞ্চলিক সেনাবাহিনী গঠন ও রাখার ক্ষমতা দিতে হবে।
লেখক: বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. স.ম. আব্দুর রহিম পাকন
সাবেক উপদেষ্ট, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, পাবনা জেলা শাখা ও কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য, সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ’৭১।