নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া শাখাওয়াতের শিক্ষাচিন্তা

শেয়ার করুন

॥ ড. মো. মনছুর আলম ॥
সাহিত্যিক, শিক্ষাব্রতী, সমাজসেবক, সমাজ সংস্কারক এবং নারী জাগরণ ও নারীর অধিকার আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন। সামগ্রিকভাবে বাংলার মুসিলম সমাজের অবস্থা, বিশেষ করে নারী সমাজের অধ:গতি, শিক্ষা-দীক্ষায় তাদের পশ্চাৎপদতা রোকেয়াকে পীড়িত ও ব্যাথিত করে। তাঁর নিজ পরিবার ও সমাজের কঠোর গোঁড়ামী ও রক্ষণশীল মনেবৃত্তি পরবর্তীকালে তাঁর কর্মচিন্তা, চিন্তা-চেতনা, সমাজ সংস্কার ও সাহিত্য সাধনার পথে যথেষ্ট প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। তিনি সম্পূর্ণ নিজের সাধনা, অসীম সাহস ও দৃঢ়চিত্ত বলে এ সমস্ত বাঁধাবিঘ্ন অতিক্রম করে নানা বিরূপ সমালোচনা উপেক্ষা করে সমাজ সংস্কার তথা মুসলিম জাগরণে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাই আধুনিক মুসলিম বাংলার নারী জাগরণের ইতিহাসে বেগম রোকেয়া শাখাওয়াতের নাম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণীয় আনন্দচিত্তে বরণীয়।
বেগম রোকেয়ার অন্যতম লক্ষ্য ছিল নারী শিক্ষার প্রসার, নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি এবং মুসলমান সমাজের অবরোধ প্রথার অবসান। তবে নারী সুরুচি ও শালীনতা বিসর্জন দিক এটা তিনি কাম্য মনে করেন নি। শিক্ষা ব্যতীত নারী জাতির অগ্রগতি ও মুক্তি সম্ভব নয়, এ সত্য অনুধাবন করেই তিনি নারী শিক্ষা প্রসারের কাজে ব্রতী হন। নারীদের তিনি প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন মানুষ হিসেবে। সমাজের অর্ধেক হিসেবে নারীর মর্যাদার স্বীকৃতির লক্ষ্যেই পরিচালিত হয় তাঁর সমগ্র প্রয়াস। তাই বাংলার নারী সমাজকে জাগরণের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে গড়ে তোলেন ‘শাখাওয়াত মেমোরিয়াল বালিকা বিদ্যালয়’ এবং ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতীনে ইসলাম’ বা মহিলা সমিতি। তাঁর মধ্যে ছিল একজন যোগ্য শিক্ষকের প্রজ্ঞা, সমাজ-সংস্কারকের অন্তর্দৃষ্টি এবং মানবতাবাদীর নির্মল চেতনা।
বাংলাসহ সমগ্র ভারতবর্ষ যখন পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ। সমাজ ছিল কুসংস্কার, কুপম-ুতা ও ধর্মীয় গোড়ামিতে আচ্ছন্ন। সমাজের মানুষ ছিল অত্যন্ত রক্ষণশীল। সে সমাজে নারীদের আবরোধ প্রথা ভেঙে শিক্ষা গ্রহণের কথা ভাবাও যেত না। এমনই এক সময়ে যুক্তিবাদী-বিজ্ঞানমনস্ক, নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া বাংলার মাটিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। রাজা রামমহনের সময় হিন্দু সমাজে সতীদাহ প্রথায় মৃত স্বামীর সাথে জীবিত স্ত্রীকে পুড়িয়ে মারা হতো, আর ওই একই সময়ে মুসলিম সমাজে অবরোধবাসিনী নারীদের শারীরিক মৃত্যু না ঘটলেও মানসিক মৃত্যু ঘটতো ছোটবেলাতেই। রোকেয়া অনুধাবন করেছিলেন, এ মানসিক দাসত্ব থেকে মুক্তির পথ শিক্ষা। সে শিক্ষা হবে অসাম্প্রদায়িক, বিজ্ঞানভিত্তিক; যে শিক্ষার উদ্দেশ্য ডিগ্রি অর্জন নয়, মনুষ্যত্ব ও মূল্যবোধ অর্জন। যে শিক্ষা নারীকে অবরোধ প্রথা থেকে মুক্তি দেবে, তাকে নিয়ে আসবে সামাজিক কর্মক্ষেত্রে। বেগম রোকেয়া নারী মুক্তির প্রথম ও প্রধান সোপান মনে করতেন সুশিক্ষা লাভ করাকে, যা নারীকে তথা গোটা মানব জাতিকে এনে দেবে প্রকৃত স্বাধীনতা।
বাংলার মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন স্ব-সমাজের নারীদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তার করার মহান ব্রতকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’। এ প্রতিষ্ঠানটি নানা বাধাবিঘœ অতিক্রম করে বাঙালি মুসলিম নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়। শৈশব থেকে মুসলমান নারীদের যে দুর্দশা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন, তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করাই ছিল এই স্কুল প্রতিষ্ঠার অন্যতম লক্ষ্য। এটি ছিল তাঁর স্বপ্ন ও চিন্তা-চেতনা বাস্তবায়নের অন্যতম ক্ষেত্র।
বেগম রোকেয়া বাংলার মুসলিম নারী সমাজের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করে অত্যন্ত হতাশ হন। তিনি ‘নবনূর’ পত্রিকার মাধ্যমে ‘অর্দ্ধাঙ্গী’ প্রবন্ধে সমকালীন নারী শিক্ষা সম্বন্ধে আক্ষেপের সাথে বলেন, “আমাদের জন্য এদেশে শিক্ষার বন্দোবস্ত সচরাচর এইরূপ- প্রথমে আরবি বর্ণমালা, অতঃপর কুরআন শরীফ পাঠ। কিন্তু শব্দগুলির অর্থ বুঝাইয়া দেওয়া হয় না; কেবল স্মরণ শক্তির সাহায্যে টিয়াপাখির মত আবৃত্তি করা। —-বঙ্গদেশের বালিকাদিগকে রীতিমত বঙ্গভাষা শিক্ষা দেওয়া হয় না। কেহ কেহ উর্দু পড়িতে শিখে, কিন্তু কলম ধরিতে শিখে না। ইহাদের উন্নতির চরমসীমা সল্মা চুমকির করূকার্য্য: উলের জুতা মৌজা ইত্যাদি প্রস্তুত করিতে শিক্ষা পর্যন্ত।”- (অর্দ্ধাঙ্গী’ নবনূর, ২য় বর্ষ, ৬ষ্ঠ সংখ্যা, পৃ. ২৮৭)। এজন্য তিনি তাঁর স্কুলের পাঠ্য সূচিতে তাফসিরসহ কুরআন পাঠের ব্যবস্থা রাখেন। এছাড়া উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আধুনিক পাঠ্যসূচি প্রণয়ন করেন। ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলের পাঠ্যসূচিতে বাংলা ইংরেজি, উর্দু, ফারসি, হোম নার্সিং, ফার্স্ট এইড, রান্না, সেলাই, বিজ্ঞান, শারীরচর্চা, সঙ্গীত প্রভৃতি সব বিষয় শিক্ষার ব্যবস্থা রাখেন।
বেগম রোকেয়া বাংলার তৎকালীন মুসলিম সমাজের দুরাবস্থা নিকট থেকে অবলোকন করেন। সমাজের এই দুরাবস্থার জন্য নারী জাতির শিক্ষার অভাবকে তিনি অন্যতম কারণ হিসেবে চি‎িহ্নত করেন। নারী উচ্চ শিক্ষিত না হলে জাতি তথা সমাজের উন্নতি অসম্ভব। তাই সমাজের উন্নতির লক্ষ্যে নারী পুরুষের সমকক্ষতা অর্জনের প্রয়োজন আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান পাঠের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন। তিনি মনে করেন শুধুমাত্র বর্ণ-পরিচয় বা প্রাথমিক শিক্ষাই নারীর জন্য যথেষ্ট নয়। সমকালীন পুরুষের মত তাদের জন্যও তিনি উচ্চশিক্ষার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “আমরা উচ্চ শিক্ষাপ্রাপ্ত না হইলে সমাজও উন্নত হইবে না। যতদিন আমরা আধ্যাতিক জগতে পুরুষদের সমকক্ষ না হই ততদিন পর্যন্ত উন্নতির আশা দুরাশা মাত্র। আমাদিগকে সকল প্রকার জ্ঞানচর্চা করিতে হইবে।”- বোরকা, মতিচুর ১ম খ-, পৃ ৬১।
স্ত্রীশিক্ষার প্রতি যে সমাজের লক্ষ্য নেই সে সমাজ কখনও উন্নতির পথে অগ্রসর হতে পারে না। ইতিহাসও তাই সাক্ষ্য দেয়। স্ত্রীশিক্ষার ওপর গুরুত্ব দেয়ার জন্য পুরুষ সমাজের প্রতি বিনীত আবেদনের সুরে তিনি ‘নবনূর’ পত্রিকার আরো বলেন, “এখন ভ্রাতাদের সমীপে নিবেদন এই, তাহারা যে টাকার শ্রাদ্ধ করিয়া কন্যাকে জড়-স্বর্ণ-মুক্তার অলঙ্কারে সজ্জিত করেন, ঐ টাকা দ্বারা তাহাদিগকে জ্ঞান ভূষণে অলঙ্কৃত করিতে চেষ্টা করিবেন। একখানা জ্ঞানগর্ভ পুস্তক পাঠে যে অনির্বচনীয় সুখ লাভ হয়, দশখানা অলঙ্কার পরিলে তাহার শতাংশের একাংশ সুখও পাওয়া যায় না। অতএব শরীর শোভন অলঙ্কার ছাড়িয়া জ্ঞানভূষণ লাভের জন্য ললনাদের আগ্রহ বৃদ্ধি হওয়া বাঞ্চণীয়। এ অমুল্য অলঙ্কার- অনলে পা পারে ইহা করিতে দহন/ সলিলে না পারে ইহা করিতে গমণ/ অনন্ত অক্ষয় ইহা অমূল্য রতন/ এই ভূষা সঙ্গে থাকে যাবত জীবন।”- (‘বোরকা’ নবনূর, ২য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা, পৃ. ২০)।
বেগম রোকেয়া শুধু পুরুষ সমাজকেই নয় স্ত্রীশিক্ষার ব্যাপারে নারী সমাজেরও যে কর্তব্য আছে সে বিষয়ে সজাগ করে দেন। তিনি নারীদেরকে তাঁদের কন্যার শিক্ষাদান ও স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য প্রয়োজনে যৌতুকের অর্থ হতে কিয়দাংশ খরচ করার আহ্বান রেখে বলেন, “সুতরাং স্ত্রী লোকদের উচিৎ যে, তাহারা বাক্সবন্দী হইয়া মালগাড়ীতে বসিয়া সশরীরে স্বর্গ লাভের আশায় না থাকিয়া স্বীয় কন্যাদের সুশিক্ষায় মনোযোগী হন। কন্যার বিবাহের সময় যে টাকা অলঙ্কার ও যৌতুক ক্রয়ে ব্যয় করেন, তাহারই কিয়দাংশ তাহার সুশিক্ষায় ও স্বাস্থ্য রক্ষায় ব্যয় করুন।”- Bengal Women’s Educational Conference-এ প্রদত্ত সভানেত্রীর অভিভাষণ, ‘সওগাত’।
শ্রীশিক্ষা সম্পর্কে বেগম রোকেয়ার চিন্তাধারা ছিল যে, শিক্ষা নারীদের মধ্যে আপন অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা, আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ জাগ্রত করবে; মুক্তি ও স্বাধীনতার প্রেরণা সঞ্চার করবে। শিক্ষার অর্থ কোন সম্প্রদায় বা জাতিবিশেষের অন্ধ অনুকরণ নয়। তাঁর মতে, “মানুষের ‘স্বাভাবিক জ্ঞান বা ক্ষমতা’কে অনুশীলন দ্বারা বৃদ্ধি করাই শিক্ষা।”- রোকেয়া রচনাবলী, মতিতুর ১ম খ-, পৃ ২। মূলত নারী মুক্তি ও নারী স্বাধীনতাই ছিল বেগম রোকেয়ার আদর্শ ও চিন্তা-চেতনা। বাংলার মুসলিম সমাজে নারী শিক্ষার বিস্তারই ছিল তাঁর আজীবনের সাধনা।
নারী মুক্তি ও নারী স্বাধীনতা সম্পর্কে তাঁর আপন চিন্তা-চেতনা ‘স্ত্রী জাতির অবনতি’ প্রবন্ধে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাবে ফুটে উঠেছে, “স্বাধীনতা অর্থে পুরুষের ন্যায় উন্নত অবস্থা বুঝিতে হইবে।—-পুরুষের সমকক্ষতা লাভের জন্য আমাদিগকে যাহা করিতে হয় তাহাই করিব। যদি এখন স্বাধীনভাবে জীবিকা অর্জন করিলে স্বাধীনতা লাভ হয়, তবে তাহাই করিব। আবশ্যক হইলে আমরা লেডী কেরানী হইতে আরম্ভ করিয়া লেডী ম্যাজিস্ট্রেট, লেডী ব্যারিস্টার, লেডী জজ সবই হইব। —- উপার্জন করিব না কেন ? আমাদের কি হাত নাই, না পা নাই, না বুদ্ধি নাই ? কি নাই ? যে পরিশ্রম আমরা স্বামীর গৃহকার্যে ব্যয় করি, সেই পরিশ্রম দ্বারা কি স্বাধীন ব্যবসায় করিতে পারি না ?”-রোকেয়া রচনাবলী, স্ত্রী জাতীর স্বপ্ন, মতিচুর ১ম খ-, পৃ. ২৯-৩০।
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নারী মুক্তি নারী অগ্রগতির জন্য নারীশিক্ষকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন। তিনি মনে করতেন নারীর অগ্রগতি মানেই সমাজের অগ্রগতি, নারীর উন্নতি মানেই সমাজের উন্নতি। এই মহিয়সী নারী ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৩২ খ্রিস্টাব্দের ৯ ডিসেম্বরই তিনি ইন্তিকাল করেন। তাই বাংলাদেশে ৯ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন-এর জন্ম ও মৃত্যু দিবস একইসাথে একইদিনে অত্যন্ত মর্যাদার সাথে পালন করা হয়। আজ ৮মার্চ ‘বিশ^ নারী দিবস’ উপলক্ষে বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত এই মহীয়সী নারীর প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা ও সশ্রদ্ধ সালাম। [কবি ও প্রাবন্ধিক, সভাপতি : সাহিত্য ও বিতর্ক ক্লাব পাবনা।]


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *