পবিত্র আশুরার তাৎপর্য ও শিক্ষা

শেয়ার করুন

।। মাওলানা শামীম আহমেদ ।।
মুহাররাম ইসলামী বর্ষপঞ্জির প্রথম মাস। ইসলামী পরিভাষায় মুহাররামের ১০ তারিখকে আশুরা বলে। আশুরা শব্দটি আরবি ‘আশারা’ থেকে এসেছে। এর অর্থ দশ। আর আশুরা মানে দশম। অন্য কথায় বলতে গেলে এ মাসের ১০ তারিখ ১০টি বড় বড় ঘটনা সংঘটিত হওয়ার কারণেও এ তারিখকে আশুরা বলা হয়। সৃষ্টির পর থেকে আশুরার দিনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে বিধায় এই দিনের মর্যাদা অনেক বেশি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেদিন আকাশ, বাতাস, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, জান্নাত-জাহান্নাম, লাওহে মাহফুজ ও যাবতীয় সৃষ্টিজীবের আত্মা সৃজন করেছেন, সে দিনটি ছিল ১০ই মুহাররম তথা পবিত্র আশুরার দিবস। আবার এ দিনেরই কোনো এক জুমার দিন হযরত ইসরাফিল (আ.) এর শিঙার ফুঁৎকারে মহাবিশ্ব ধ্বংস হবে নেমে আসবে মহা প্রলয় কিয়ামত।

আশুরার দিন বা মহররমের ১০ তারিখ যেসব তাৎপর্যময় ঘটনা সংঘটিত হয়েছিল, সংক্ষেপে সেগুলো হলো :
১. এ দিনে মহান আল্লাহ তাআলা পৃথিবী সৃষ্টি করেন। ২. আবার এ দিনেই কিয়ামত সংঘটিত হবে। ৩. এ দিনে হজরত আদম (আ.) এবং মা হাওয়া (আ.) বেহেশত থেকে দুনিয়ায় নেমে আসেন। ৪. মুহররমের ১০ তারিখে আল্লাহ তায়ালা নূর নবিজির (দ.) অসিলায় হযরত আদম এবং মা হাওয়া (আ.) এর তাওবা কবুল করেন। ৫. এ দিনেই মা হাওয়া (আ.)-এর সঙ্গে আরাফার ময়দানে বাবা আদম (আ.) এর সাক্ষাৎ ঘটে। ৬. হজরত নুহ (আ.)-এর জাতির অবাধ্য লোকেরা আল্লাহর গজব মহাপ্লাবনে নিপতিত হওয়ার পর আল্লাহ তায়ালা ১০ মুহররমের দিন নৌকাসহ ইমানদার বাহিনীকে জুদী পাহাড়ে অবতরণ করান। ৭. হজরত ইবরাহিম (আ.) নমরুদের অগ্নিকুন্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ৪০ দিন পর ১০ মুহররম সেখান থেকে মুক্তি লাভ করেন। ৮. হজরত আইয়ুব (আ.) ১৮ বছর কঠিন রোগ ভোগ করার পর মুহররমের এ দিনে আল্লাহর রহমতে সুস্থতা লাভ করেন। ৯. হজরত ইয়াকুব (আ.)-এর পুত্র হজরত ইউসুফ (আ.) তাঁর ১১ ভাইয়ের ষড়যন্ত্রে কূপে পতিত হন এবং এক বণিক দলের সহায়তায় মিসরে গিয়ে হাজির হন। তারপর আল্লাহর বিশেষ কুদরতে তিনি মিসরের প্রধানমন্ত্রী হন। ১০. আবার ৪০ বছর পর ১০ মুহররমে পিতার সঙ্গে পুত্রের অপূর্ব মিলন হয়। ১১. হজরত ইউনুস (আ.) জাতির লোকদের প্রতি হতাশ হয়ে নদী অতিক্রম করে দেশান্তরিত হওয়ার সময় নদীর পানিতে পতিত হন এবং মাছ তাঁকে গিলে ফেলে। মাছের পেট থেকে তিনি আল্লাহর রহমতে ৪০ দিন পর মুক্তি পান ১০ মহররম তারিখে। ১২. হজরত মুসা (আ.) ফেরাউনের অত্যাচারের কারণে তাঁর দলবলসহ অন্যত্র চলে যান। পথিমধ্যে নীল নদ পার হয়ে তিনি ফেরাউনের হাত থেকে আশুরার দিন মুক্তি পান। আর ফেরাউন তার দলবলসহ নীল নদের পানিতে ডুবে মারা যায়। ১৩. হজরত ঈসা (আ.)-এর জাতির লোকেরা তাঁকে শহীদ করার চেষ্টা করলে মহররমের ১০ তারিখ আল্লাহ পাক তাঁকে আসমানে উঠিয়ে নিয়ে মুক্তি দান করেন। ১৪. এ দিন হজরত সুলাইমান (আ.) সাময়িকভাবে হারানো রাজ্য পুনরায় ফিরে পান। এবং তার পিতা হজরত দাউদ (আ.) এর উপর জবুর কিতাব নাযিল করা হয়। ইত্যাদি।

এই আশুরার দিনেই ঘটে গেছে ইতিহাসের এক মর্মস্পর্শী ঘটনা। আর তা হলো, মহানবী (দ.)-এর দৌহিত্র হজরত ইমাম হুসাইন (রা.)-এর পবিত্র শাহাদাত এই আশুরার দিনেই হয়। ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে হিজরি ৬১ সালের ১০ মহররম হজরত হুসাইন (রা.) সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে কারবালার প্রান্তরে ইয়াজিদের বাহিনীর হাতে সপরিবারে অত্যন্ত নির্মমভাবে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। সেদিন হজরত হুসাইন (রা.)-এর শোকে বিহবল কারবালার আকাশ গম্ভীর হয়ে মুখ ঢেকে ছিল। বাতাস হয়েছিল গতিপথ হারিয়ে নিষ্প্রাণ। গাছ-তরুলতা হু হু করে কেঁদেছিল। পাখপাখালির কলরব বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ইরাকের ফোরাত নদীর কলতান ক্ষণিকের জন্য থমকে গিয়েছিল।

কারবালার প্রান্তরে হজরত হুসাইন (রা.) নিজের প্রাণ কুরবানী দিয়ে অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করার যে শিক্ষা দিয়ে গেছেন, সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য এ আত্মত্যাগ বিশ্বের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে আছে। হজরত হুসাইন (রা.) হিকমতের পথ অবলম্বন করে ইয়াজিদের আনুগত্য স্বীকার করতে পারতেন। কিন্তু তিনি ও আহলে বাইতের অন্যান্য সদস্য সে পথ অবলম্বন করেননি। তিনি যে একাই শহীদ হয়েছেন, তা নয়। তিনি এক এক করে প্রত্যেক যুবককে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠালেন। ত্যাগের আত্মদান স্বচক্ষে অবলোকন করলেন। তারপর কারবালার প্রান্তরে সর্বশেষ শহীদ হলেন হজরত হুসাইন ইবনে আলী (রা.) নিজেই। ইরাকের কারলার ময়দানে তাঁর সাথীরা ক্ষুধার্ত, পিপাসার্ত, অত্যাচারিত, তবুও সত্যকে তিনি বিসর্জন দেননি;কারণ তিনি জান্নাতের সরদার ইমাম হুসাইন (রা.)। তিনিই সত্যকে, দ্বীনকে মর্যাদার উচ্চ শিখরে স্হাপন করেছেন। নিজ জীবনে রক্তের শেষ বিন্দু কারবালার জমিনে উৎসর্গ করে দ্বীন ইসলাম ও উম্মতে মুহাম্মাদী (দঃ) কে দুনিয়ার বুকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে গেছেন। প্রতিবছর আমাদের মাঝে মুহররম মাস ফিরে এসে সেই শিক্ষার কথাই পুনর্বার স্মরণ করিয়ে দেয়। আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে পবিত্র আশুরার বরকত এবং কারবালার শিক্ষা অনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন। আহলে বাইত (দ.) এর রুহানি সন্তুষ্টি আল্লাহ আমাদের নসিব করুন। আমিন।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *