পাবনা ক্যালিকো কটন মিল্স-এর জায়গায় ‘সাহাবুদ্দিন সিলিকন সিটি’ গড়ে তুলুন

শেয়ার করুন

॥ ড. মো. মনছুর আলম ॥
পাবনা একটি ঐতিহ্য সমৃদ্ধ প্রাচীন জনপদ। এই জনপদের রয়েছে একটি সুসমৃদ্ধ ইতিহাস। বঙ্গ সভ্যতার ন্যায় এর রয়েছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছরের সভ্যতার ইতিহাস। পাবনা সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিনির্মাণে রয়েছে প্রায় তিন ডজন নদ-নদী। দেশের বৃহৎ দু’টি নদী পদ্মা-যমুনা দ্বারা বেষ্টিত পাবনা জেলার হৃদয়ভূমি ইছামতি নদী। এই নদ-নদীর হৃদয় নিংড়ানো প্রেম-ভালোবাসা, স্নেহ-মমতা ও তার দু’বাহু উজাড় করা দানে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গড়ে উঠেছে নদী মেঘলা, পলি বিধৌত সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা আমাদের এই প্রিয় ভূখ-টি। মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের অপার মহিমা ও দান এটি। পাবনার নদ-নদীর ঢেউয়ের কলতান এবং দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ-শ্যামলিমার নমনীয় ঊর্বরা শরীরে তার ঐশ্বর্যম-িত সৌন্দর্যে গড়ে উঠেছে আমাদের হাজার হাজার বছরের লালিত সভ্যতা-সংস্কৃতি। এই সাড়ে তিন হাজার বছরের ‘পাবনা সভ্যতা’র ইতিহাসে এই প্রথম রাষ্ট্রপতি পেলো পাবনা জেলা। দেশ স্বাধীনের পর ৫২ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে পাবনাকে। ১৯৭১ সালে মহাকাব্যিক মুক্তিযুদ্ধে পাবনার সূর্যসন্তানদের ভূমিকা ছিল অগ্রগণ্য। তবুও পাবনাকে অপেক্ষা করতে হলো দীর্ঘদিন, দীর্ঘ বছর। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর অত্যন্ত পছন্দের ও ভালোলাগার জেলা ছিল পাবনা জেলা। তাঁরই সুযোগ্য কন্যা, মানবতার মা, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার অগ্রনায়ক, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের স্বপ্নদ্রষ্টা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে উপহার দিলেন অধিকতর যোগ্য ২২তম রাষ্ট্রপতি, আর পাবনাকে উপহার দিলেন হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা। যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান প্রতিদান দিলেন পিতার ভালোলাগার ভালোবাসার জেলাকে। পাবনার ধূলো-মাটির সন্তান মো. সাহাবুদ্দিন এখন রাষ্ট্রপতি; ভাবা যায়া! পাবনাবাসীর জন্য এটা শুধু আনন্দেরই নয়; অত্যন্ত মর্যাদা ও গর্বের বিষয়।
পাবনাবসীকে এই আনন্দে আত্মহারা হলে চলবে না। আমাদের এই মহান সুযোগকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। অনেকে বলে থাকেন পাবনাবাসী অবহেলিত বঞ্চিত। আমি এদের দলে নই। কী নেই পবনা জেলাতে? বর্তমানে পাবনা উত্তর জনপদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ শিক্ষা নগরীতে পরিণত হয়েছে। দেশের একমাত্র পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র পাবনাতে, হার্ডিঞ্জ ব্রিজ, রেল লাইন, মেডিকেল কলেজ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়, টেক্রটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, মেরিন একাডেমিসহ নানান কিছু আমরা পেয়েছি। আমারা হারিয়েছি বা আমাদের দীর্ঘশ্বাসও অছে অনেক। যেমন বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু; ঈশ্বরদী রেল লাইন আসার পরেও কেন শহরে রেল লাইন আসতে দেড়শো বছর সময় লেগে গেলো? এমন প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় অনেককে। আমি বলি এটা কোনো অবহেলা বা নেতৃত্বের দোষ নয় এটা পাবনার কিছু মানুষের লোভ ও লাভের হিসাবের কারণে হয়েছে। যাকে বলে মাটির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা বা মায়ের সাথে বেইমানি। যেমনটা আমরা ইছামতি নদী উদ্ধার আন্দোলন করতে গিয়ে হারে হারে টের পাচ্ছি। ইছামতির দানে সোনার ফসল ভরা বিশাল মাঠ, সুবিস্তীর্ণ তৃণভূমি, নদীর তীরে গড়ে উঠা সবুজ বৃক্ষরাজি প্রকৃতির অপপরূ শোভা-সমারোহের এই নিসর্গ নীলিমা অর্থাৎ ইছামতির তীর। যেখানে দু’দ- দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে ছুটে এসেছে প্রকৃতিপ্রেমি মানুষ। ইছামতি তীরেই শুরু হয়েছিল মনুষ্য সৃষ্ট সভ্যতার জয়যাত্রা; পাবনা সভ্যতার জয়যাত্রা। পাবনার সুরম্য নগর, বাজার, বন্দর, বৃক্ষশ্যামল গ্রাম, কৃষির পত্তন, শিল্পের সমৃদ্ধি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, ধর্ম-কর্ম প্রভৃতি বিকশিত হয়েছে এই ইছামতি নদীকে ঘিরেই। ইছামতি নদী তীরেই পাবনা শহর গড়ে উঠেছে। বর্তমানে এই মাতৃসম-স্তন্যদাত্রী ইছামতি নদীকে ধীরে ধীরে খুবলে খাচ্ছে বা খেয়েছে তারই অকৃতজ্ঞ সন্তানেরা। নদীর উজাড় করা দান ভুলে এখন নদীকে গ্রাস করার খেলায় মত্ত পাবনাবাসী। বর্তমানে এক হাজারের ও অধিক নদীদস্যূ বা দখলদার যারা পাবনারই সন্তান, ইছামতির দানেই লালিত-পালিত। আমার মনে হয়, পাবনার ঘাতকদের চেনার জন্য এই একটি উদাহরণই যথেষ্ট।
আমরা জানি পাবনাতে অনেক সমস্যা আছে, বিশেষ করে আমি পাবনার নদ-নদী, রাস্তাঘাট, পুকুর, খাল-বিল-জলাশয়, পাবনা নগরায়ণ নিয়ে ২০১৫ সাল থেকে কাজ করতে গিয়ে খুব কাছ থেকে দেখেছি পাবনাকে। এটাও জানি আমাদের নেতৃবৃন্দ অনেক অনেক সমস্যার কথা তাদের প্রিয় নেতা, প্রিয় সন্তান, মহামান্য রাষ্ট্রপতির নিকট তুলে ধরবেন। তুলে ধরবেন ভবিষ্যৎ পাবনা উন্নয়ন পরিকল্পনার রূপরেখা। যতটুকু জেনেছি, বিশেষকরে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বরাবর কয়েকটা স্মারকলিপি লিখতে গিয়ে যে বিষয়গুলো সম্বন্ধে আমি অবগত আছি। যেমন- ইছামতি নদী উদ্ধার ও সংস্কার, নদী কেন্দ্রিক শহরে বিনোদন পার্ক; পাবনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন; পাবনা পুরাতন টেলিগ্রাফ অফিসকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে রূপান্তর; নগরবাড়ি-আরিচা-গোয়ালন্দকে সংযুক্ত করে ওয়াই টাইপ পদ্মা বহুমুখী সেতু; গাজনার বিলকে আধুনিক পর্যটন মডেলের বিল হিসেবে রূপান্তরকরণ ইত্যাদি।
পাবনাবাসী বিশেষ করে পাবনার নেতৃবৃন্দকে এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, পাবনা জেলায় এখন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা অনেক। ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের স্বপ্নদ্রষ্টা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার বহুমুখী প্রতিভার অন্যতম স্ফুরণ সারাদেশে ২৮টি ‘হাইটেক পার্ক’ স্থাপন; যা ধীরে ধীরে বাস্তবায়িত হবে। এরমধ্যে ‘যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি’র আদলে রাজশাহীতে স্থাপন করা হয়েছে ‘বঙ্গবন্ধু সিলিকন সিটি’। যেখানে ১৪ হাজার তরুণ-তরুণীর কর্মসংস্থান হবে। পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের সামনে পরিত্যক্ত ‘পাবনা ক্যালিকো কটন মিল্স’-এর জায়গায় এ রকম একটি ‘হাইটেক পার্ক’ বা ‘সিলিকন সিটি’ স্থাপন করা যেতে পারে; যা একদিকে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে সেইসাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার কাজ অনেকটা ত্বরান্বিত হবে বলে আমি মনে করি। আমাদের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে এত অল্প জায়গায় এই বিশাল কর্মযজ্ঞ অর্থাৎ সিলিকন সিটির মত বিশাল আইটি যজ্ঞ গড়ে তোলা কি সম্ভব? খোলা চেখে পাবনা ক্যালিকো কটন মিল্স-এর জায়গা দেখতে কম হলেও কাগজ-কলমে কিন্তু ৪০ একর জায়গা পড়ে আছে। আমরা জানি রাজশাহী ‘বঙ্গবন্ধু সিলিকন সিটি’ গড়তে সরকারের প্রায় ৩২ একর জায়গা লেগেছে। সেখানে আমাদের রয়েছে প্রায় ৪০ একর জায়গা। সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, বর্তমানে এই পরিত্যক্ত জায়গাটির ঘরগুলোতে মাদকসেবীদের অভায়াশ্রমে পরিণত হয়েছে, পরিত্যক্ত পুকুর-পুষ্করিণীতে মাছ ছাড়া নিয়ে কিংবা ইজারা নিয়ে এলাকাবাসীর মধ্যে মারামারি, চোর-ডাকাতের নিরাপদ স্থান, স্কুল-কলেজ পালানো ছেলে মেয়েদের আড্ডা দেওয়ার নিরাপদ স্থান, বখাটেদের টিকটক খোলা প্রভৃতি অপকর্মের নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে। এছাড়া জায়গাটি দীর্ঘদিন পরিত্যক্ত থাকায় সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করাও জরুরি বলে মনে করি।
আমার মনে হয় পাবনার নেতৃবৃন্দ আমাদের সমস্যাগুলো ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা তুলে ধরার পাশাপাশি শিক্ষিত যুব সমাজের কথা এবং স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার নিমিত্তে ‘সাহাবুদ্দিন সিলিকন সিটি’ গড়ে তোলার কথা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে তুলে ধরবেন। এতে ত্রিমুখী লাভবান হবে পাবনা জেলার। এক. মহামান্য রাষ্ট্রপতি খুশি হবেন এ ভেবে যে, তিনি ভবিষ্যৎ পাবনা ঐতিহ্যের অংশ হচ্ছেন; দুই. পাবনার শিক্ষিত বেকার সমস্যার অনেকটা সমাধান হবে; তিন. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের স্বপ্ন পূরণে এক ধাপ এগিয়ে যাবে। পাবনাবাসীর বিশেষ করে পাবনার নেতৃবৃন্দের শুভবুদ্ধির উদয় হোক এই প্রত্যাশা। [ লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক ও পাবনা গবেষক।]


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *