পেকিন হাঁস পালনে স্বাবলম্বী হচ্ছে গ্রামের কর্মহীন নারীরা

শেয়ার করুন

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ অভাব অনটনের সংসারে নুন আনতে পানতা ফুরায়, এক সময় জীবন ধারন করা খুবই কঠিন হয়ে যায় গ্রামাঞ্চলের কর্মহীন নারীদের। তাদের সাবলম্বী করতে আর্থিক ও প্রশিক্ষণ দিয়ে পাশে দাঁড়ায় প্রোগ্রামস ফর পিপলস ডেভেলপমেন্ট (পিপিডি) নামের একটি বে-সরকারি সংস্থা। নিজের স্বপ্ন পুরনের লক্ষ্যে পরিশ্রমের মাধ্যমে পেকিন হাঁস পালন করে সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেছেন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া ও শাহজাদপুর উপজেলা এবং পাবনা জেলার বেড়া অঞ্চলের দরিদ্র কর্মহীন নারীরা। তাঁরা হয়ে উঠেছেন স্বাবলম্বী ও আত্মনির্ভরশীল, জয় করছেন দারিদ্রতাকে। তাদের প্রচেষ্টা দেখে বাড়তি আয়ের আশায় এলাকার অনেকেই আগ্রহী হচ্ছেন পেকিন হাঁস পালনে। পরিবারের বোঝা এবং স্বামী সংসারের ওপড় নির্ভরশীল না হয়ে নিজে আত্ম কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে শুরু করেছেন হাঁস পালন। সুস্বাদু, দ্রুত বর্ধনশীল ও অল্প সময়ে বেশি লাভ হওয়ায় পেকিন হাঁস পালনে আগ্রহ বেড়েছে খামারীদের মাঝে।

পল্লীকর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ)’র আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় এবং প্রোগ্রামস ফর পিপলস ডেভেলপমেন্ট (পিপিডি)’র সার্বিক তত্ত্ববধানে উল্লাপাড়া উপজেলায় ১০টিরও বেশি পেকিন হাঁসের খামার গড়ে উঠেছে। পেকিন হাঁসের শারীরিক গঠন খুবই সুন্দর। এদের বুকে অনেক মাংস থাকে এবং ত্বক মর্সণ ও অনেক সাদা। এই জাতের হাসগুলোর পা কমলা-হলুদ রঙের হয়। শুধু তাই নয়, এই জাতের হাস দ্রুত বর্ধনশীল। দুই থেকে আড়াই মাসে এটি আড়াই থেকে সাড়ে তিন কেজি ওজন হয়। অর্থাৎ অতি কম সময় পালনের মাধ্যমে হাঁসগুলো বিক্রি উপযোগী হয়। প্রতি কেজি হাঁস বিক্রি হয় ৩৫০ থেকে ৪০০টাকায়। অর্থাৎ ৩ মাস পালনের পর একটি হাঁসের বাজার মুল্য প্রায় এক হাজার থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা। এই জাতের হাঁস জলবায়ু সহিষ্ণু এবং রোগ বালাই অনেকাংশে কম।

পিপিডি’র সহায়তায় ২০২৪ খ্রি. সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া সিংহগাঁতী দহপাড়ার জামেলা খাতুন ৮০টি হাঁসের বাচ্চা নিয়ে খামারের যাত্রা শুরু করেন। প্রথম ৮০টি হাঁস থেকে তার প্রায় ৪৫ হাজার টাকা আয় হয়। এরপর তিনি পুনরায় পেকিন জাতের বাচ্চা সংগ্রহ করে পালন করেন এবং বর্তমানে তার খামারে ১৫০টি পেকিন হাঁস রয়েছে। সব মিলিয়ে এ অঞ্চলে ১০টি খামারে প্রায় ১ হাজার হাস পালন করছেন নারীরা।

সিংহগাঁতীর জামেলা খাতুন নামের এক নারী বলেন, তার এই সফলতা দেখে আশপাশের অনেকেই এখন পেকিন জাতের হাঁস পালনের দিকে ঝুঁকছেন। এই হাঁসের রোগ বালাই অন্যান্য হাঁস থেকে অনেক কম ও মাংস স্বাদ বেশি। তাই বাজারে এই হাসের মাংসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

এলাকার প্রতিবেশী সূর্য খাতুন ও জোসনা খাতুন বলেন, আমরা জামেলা খাতুনের হাঁসের খামার দেখে উৎসাহিত হয়ে এই জাতের হাঁসের খামার করেছি। আমাদের খামারে ১০০টি করে হাঁস আছে। প্রতিটি হাঁসের ওজন প্রায় দুই কেজি হয়েছে। হাসগুলো দেখতে হিষ্টপুষ্ট হয়েছে। আশা করছি এক মাস পর বিক্রি করবো। এতে আমাদের খরচ বাদে প্রায় ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা লাভ হবে। অল্প সময়ে বেশি লাভ হওয়ায় আগামিতে খামার বড় করে বেশি হাঁস পালনের ইচ্ছা আছে।

পাবনা বেড়া উপজেলার চাকলা পূর্বপাড়া সুমাইয়া খাতুন বলেন, আমাদের খামারে ৫০টি পেকিন হাঁস আছে। আড়াই কেজির মতো ওজন হয়েছে, মাংসের ভালো স্বাদ শুনেছি, অনেকে কেনার জন্য আসছে তবে এখনও বিক্রয় করছি না, যেভাবে বেড়ে উঠছে আর কয়টা দিন গেলে সাড়ে ৩ কেজির মতো ওজন হলে বিক্রয় করবো।

পাবনা বেড়া উপজেলার করমজা পশ্চিম পাড়ার জিয়াসমিন বলেন, আমাদের খামারের হাঁসগুলো খুব তাড়াতাড়ি বড় হয়ে গেল, সমিতি থেকে ঋণ নিয়ে ৩০টি হাস তুলেছিলাম, শীতের মধ্যে হাঁসের মাংসের স্বাদ একটু বেশি হওয়ায় চাহিদা বৃদ্ধির কারণে ভালো দাম পেয়েছি। আগামীতে আরও বড় পরিসরে খামার বাড়ানোর চিন্তা আছে।

পিপিডি’র পাবনা ও সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা কৃষিবিদ রাফি আলম বলেন, বর্তমানে তাদের তত্ত্বাবধানে উল্লাপাড়ায় ১০টি, শাহজাদপুর ১০টি এবং পাবনার বেড়ায় প্রায় ১৫টি ছোট মাঝারী আকারের পেকিন জাতের হাঁসের খামার চলমান। দিন দিন এর চাহিদা বেড়েই যাচ্ছে কারণ অতি অল্প সময়ে খামারীরা বেশি লাভবান হচ্ছেন। অন্যদিকে রোগ বালাই কম বলে ঝুঁকি কম এবং এন্টিবায়োটিক ব্যাবহার করা হয়া না বলে এই হাঁসের মাংস নিরাপদ ও স্বাস্থ্য সম্মত।

উল্লাপাড়া উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ শেখ এম এ মতিন বলেন, বাংলাদেশের সকল অঞ্চলে পেকিন জাতের হাঁসের মাংসের চাহিদা রয়েছে। অল্প সময়ে দ্রুত বাড়ার কারণে লাভ বেশি। নারীরা এই হাস পালনে আর্থিকভাবে সাবলম্বী হচ্ছে। সম্পুর্ণ নিরাপদ ও পুষ্টিগুনের দিক দিয়েও অনেক ভালো। উপজেলা প্রাণিসম্পদের পক্ষ থেকে এসব অঞ্চলের পেকিন হাঁস পালনে খামারীদের মাঝে প্রশিক্ষণসহ সব ধরনের কারিগরি সহযোগিতা প্রদান করে থাকি। এছাড়াও বাজার ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে খামারীদের বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ দেই। সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া, শাহজাদপুর ও পাবনা জেলার বেড়া এবং চলনবিলের কিছু অংশজুড়ে প্রতি ছয় মাস অন্তর ক্ষুদ্র খামারীদের নিয়ে প্রায় ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকার পেকিন হাঁস জাতের মাংসের বাজার সৃষ্টি হয়েছে।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *