ফারাক্কা ও তিস্তা প্রভাবে বিরান ভূমিতে পরিণত হতে যাচ্ছে উত্তর জনপদ

শেয়ার করুন

। । ড. মো. মনছুর আলম । ।
তিস্তা নদী ৩১৫ কিমি দৈর্ঘ্যের বাংলাদেশ অংশ ১১৫ কিমি। এই নদীর মাসিক গড় পানি প্রবাহের পরিমাণ ২ হাজার ৪৩০ কিউসেক। বাংলাদেশের তিস্তা বাঁধ এলাকা থেকে ১০০ কিমি উজানে ভারত জলপাইগুড়ি জেলার গজলডোবা নামক স্থানে একটি বাঁধ নির্মাণ করেছে। এই বাঁধের সাহায্যে তারা একটি খালের মাধ্যমে শুষ্ক মৌসুমে ১ হাজার ৫০০ ঘনমিটার পানি মহানন্দা নদীতে নিয়ে যায়। আবার বর্ষা মৌসুমে বাঁধের সমস্ত কপাট খুলে দেয়; ফলে ভাটির সমস্ত এলাকা ব্যাপকভাবে প্লাবিত হয় এবং খর¯্রােতা প্রভাবের কারণে ভাঙন প্রক্রিয়া হয়ে উঠে দুর্দদমনীয়। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর বাংলাদেশ-ভারত ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করলেও তিস্তা চুক্তি নিয়ে টানাপোড়েন চলছে দীর্ঘ পঞ্চাশ বছরেরও অধিক সময় ধরে। এভাবে দশকের পর দশক ধরে দরকষাকষির এক পর্যায়ে বাংলাদেশের সাথে অভিন্ন নদী তিস্তার পানি বণ্টনের খসড়া চুক্তিতে একমত হয় ভারত। সে মোতাবেক ২০১১ সালের সেপ্টম্বর মাসে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং ঢাকা সফরে আসেন। বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দ্বি-পাক্ষিক বিভিন্ন চুক্তি স্বাক্ষর করলেও তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপধ্যায়ের বিরোধিতার জন্য তা আর আলোর মুখ দেখেনি। এরপর ২০১৭ সালে নয়া দিল্লির হায়দারাবাদ হাউজে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে আস্বস্ত করেছিলেন তাঁর প্রধানমন্ত্রীত্বের মেয়াদের মধ্যেই তিস্তা পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বার বার তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও চুক্তি সই হয়নি। এদিকে ২০১৯ সালের মে থেকে তিনি আবারও ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এবং পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপধ্যায় ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশ তিস্তা চুক্তির আশা এক প্রকার ছেড়েই দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের এই নিষ্ক্রিয়তার ফলে মমতা বন্দ্যোপধ্যায় আবার দুর্ভিসন্ধি শুরু করেন। তিনি তিস্তা নদীর পানি আরোও সরাতে দুটি নতুন খাল খননের জন্য ইতোমধ্যে প্রায় ১ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করেছেন। গত ৪ মার্চ’২০২৩ শনিবার ভারতের ইংরেজি দৈনিক টেলিগ্রাফ পত্রিকার মাধ্যমে জানা যায়, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার জেলার কৃষিজমি সেচের আওতায় আনতেই মূলত খাল দু’টি খননের এই উদ্যোগ গ্রহণ করছে ভারত সরকার। পরিকল্পনা অনুয়ায়ী তিস্তা ও জলঢাকা নদী থেকে পানি সরাতে কোচবিহার জেলার চ্যাংড়াবন্দা পর্যন্ত ৩২ কিলোমিটার দীর্ঘ খাল খনন করা হবে এবং তিস্তার বাম তীরে ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ আরেকটি খাল খনন করা হবে। এই দু’টি সেচ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ১ লক্ষ কৃষককে সেচ সুবিধার আওতায় আনা হবে। উভয়দেশের মধ্যে সরকারি পর্যায়ে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকলেও তিস্তার ব্যাপারে এমনকি নতুন করে দু’টি খাল খননের ব্যাপারে বাংলাদেশকে জানানোর প্রয়োজনবোধ করেনি ভারত। তিস্তা পানি বণ্টন নিয়ে দু’দেশের মধ্যে কোনো চুক্তি না থাকলেও খাল দু’টি খননের বিষয়ে বাংলাদেশকে অবহিত করা উচিত ছিল বলে আমরা মনে করি। এছাড়া অতি দ্রুত যৌথ নদী কমিশনের মাধ্যমে এ বিষয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগ জানানো উচিৎ হবে বলেও মনে করি। কারণ এমনিতেই পানির আভাবে উত্তর জনপদের বিস্তীর্ণ এলাকা এখন শুধু ধু-ধু বালিচর। তিস্তা প্রভাবে উত্তর জনপদের আবহাওয়া মাঝে মাঝে রুক্ষ ও রুদ্রমূর্তি ধারণ করতে দেখা যাচ্ছে। এছাড়া নদী ভাঙন, অসময়ে বন্যা বা আকস্মিক বন্যা নিত্য ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। পানির অভাবে বাংলাদেশের রংপুরের ডালিয়ায় তিস্তা বাঁধ প্রকল্পের কার্যকারিতা এখন মুখ থুবড়ে পড়েছে। সেইসাথে তিস্তা নদী সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন শাখা নদী, উপনদী পানির অভাবে মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। ফলে নৌচলাচল, নৌবাণিজ্য ও কৃষি খাতে এর মারাত্মক প্রভাব দেখা দিয়েছে। উত্তর জনপদের বিস্তীর্ণ এলাকা জুরে এখন পরিদৃষ্ট হয় শুধু ধু-ধু বালিচর। এবার আসা যাক গঙ্গা-পদ্মা নদী নিয়ে আলোচনা।
গঙ্গা-পদ্মা নদী ধারার ২ হাজার ৬০০ কিমি দৈর্ঘ্যের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পদ্মা নদীর দৈর্ঘ্য ৩৭৮ কিমি। বাংলাদেশে প্রবেশের পর থেকে গোয়ালন্দ ঘাট যমুনা নদীর সাথে মিলন পর্যন্ত ২৫৮ কিমি; এখান থেকে চাঁদপুর মেঘনার সাথে মিলন পর্যন্ত দৈর্ঘ্য ১২০ কিমি ; যা পদ্মা নামে পরিচিত। ভারত বাংলাদেশের উজানে ফারাক্কা বাঁধসহ বিভিন্ন সেচ ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে একতরফাভাবে পানি সরিয়ে নিচ্ছে। পদ্মায় পানি প্রবাহ না থাকায় উত্তর বাহুতে শাখা নদী বড়াল, কমলা, চন্দ্রাবতী, রতনাই, সুতার গাঙ, বান্নাই, বাদাইসহ অসংখ্য শাখা-প্রশাখা মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। খাতাকলমে পদ্মা নদীর বৈশিষ্ট্য বারোমাসী হলোও প্রকৃতপক্ষে নদীতে কয় মাস এবং কী পরিমাণ পানি থাকে? কেন পানির স্বল্পতা? এমন প্রশ্নের উত্তর এখন প্রায় সকল মানুষের জানা। শুধু জানা নেই তাদের ভবিষ্যৎ কী হতে যাচ্ছে? তবে কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে। কারণ তিস্তা ও ফারাক্কা প্রভাবে উত্তর জনপদের আবহাওয়া রুক্ষ ও রুদ্রমূর্তি ধারণ করতে দেখা যাচ্ছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের পেছনে উত্তরের জনগণ ও বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন মনে করেন এসব মানবসৃষ্ট বা ভারত সৃষ্ট। ভারত কর্তৃক পদ্মা নদীর উজানে ফারাক্কা বাঁধ ও তিস্তা বাঁধ নির্মাণ বাংলাদেশের অসংখ্য নদ-নদীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। অপমৃত্যু ঘটেছে তিস্তা ও পদ্ম নদীর শাখা ও উপনদীগুলোর। তিস্তা-পদ্মায় পানি প্রবাহ হ্রাস পাওয়ায় বর্তমানে নদীগুলোতে শত শত চর জেগে উঠেছে। উত্তর জনপদের প্রায় সকল নদ-নদী এখন ধু-ধু বালিচর। মূলত নদ-নদীর প্রভাবেই জলবায়ু এখন রুক্ষ ও রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে। আবহাওয়ার এই অস্বাভাবিক পরিবর্তনে গ্রীষ্মকালে যেমন তাপমাত্রা অনেক বেশি বেড়ে যাচ্ছে তেমনি শীতকালে প্রচ- শীত ও ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকছে আকাশ। গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রা বেড়ে ৪০ থেকে ৪৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত হচ্ছে এবং শীতকালে তাপমাত্রা কমে ৭/৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডে নেমে আসছে। ফলে জনজীবনে পড়ছে এর বিরূপ প্রভাব। ভূ-গর্ভস্থ পনি হ্রাস এবং পানির লেয়ার অনেক নিচে চলে যাওয়ায় মানুষ এখন উৎকণ্ঠিত বেশি। এ অবস্থা চলতে থাকলে কৃষিনির্ভর কৃষিপ্রধান এলাকায় ভবিষ্যতে সুপেয় পানির অভাবসহ সেচ ও কৃষি ব্যবস্থা দারুণভাবে ব্যহত হবে, ব্যহত হবে স্বাভাবিক জীবন-যাপন। ফলে হুমকির মুখে পড়বে এ অঞ্চলের প্রায় ৫ কোটি মানুষসহ জীববৈচিত্র্য। বর্তমানে জীববৈচিত্র্যের অস্বাভাবিকতা পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ভাবিয়ে তুলছে। কৃষি বাংলাদেশের প্রধান অর্থনৈতিক খাত এবং পানির প্রধান ব্যবহারকারী শিল্প। কৃষিখাত ছাড়া পানির আবাসিক ও বাণিজ্যিক ব্যবহারও ব্যাপক। নদী-নালা এবং পুকুর-বিল-হাওর-বাঁওড় ইত্যাদি, মৎস্য, বন ও নৌ-পরিবহন ইত্যাদি খাত ছাড়াও পানি জীবন রক্ষা, পরিবেশ দূষণ রোধ, লবণাক্ততা নিয়ন্ত্রণ, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা, যোগাযোগ, বিনোদন প্রভৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পদ্মা নদীর তলদেশ ওপরে উঠে আসা, মিঠা পানির প্রবাহ কমে যাওয়া নদীতে এখন আর তেমন ইলিশ ধরা পড়ছে না। গাঙ্গেয় পানি ব্যবস্থায় শোল, গজার, রুই, কাতলা, চিতল, বোয়াল, বাঘাইর, পাঙাস, পাপদা, মলা, ঢেলাসহ প্রায় দুইশতাধিক প্রজাতির ছোট-বড় মিঠা পানির মাছ ও ১৮ প্রজাতির চিংড়ি মাছ ছিল; সেগুলো এখন বিলুপ্তির পথে। শুধু উত্তরাঞ্চলই নয় পদ্মার সাথে দক্ষিণাঞ্চলও একই সমস্যা দেখা দিচ্ছে। কারণ পদ্মার দক্ষিণবাহু হতে নির্গত শাখা নদী মাথাভাঙ্গা, কুমার, গড়াই, আড়িয়ালখা এবং প্রশাখা ইছামতি, মধুমতি, পশুর, কপোতাক্ষ নদীসহ প্রায় ২৫টি নদী পানির অভাবে মরুকরণ অবাস্থা বিরাজ করছে। গঙ্গা অববাহিকায় মোট নিকাশি অঞ্চলের আয়তন ১০ লাখ ৮৭ হাজার ৪০০ বর্গ কিমি। এরমধ্যে বাংলাদেশে পদ্মার মোট নিকাশি অঞ্চলের আয়তন ৪৬ হাজার ৩০০ বর্গ কিমি। নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে এক লাখ ও তদ্দুর্ধ জনসংখ্যা অধ্যুষিত প্রথম শ্রেণির শহর ২৯টি, পঞ্চাশ হাজার ও তদ্দুর্ধ জনসংখ্যা অধ্যুষিত দ্বিতীয় শ্রেণির শহর ২৩টি এবং পঞ্চাশ হাজারের কম অধ্যুষিত জনসংখ্যার তৃতীয় শ্রেণির শহর রয়েছে ৪৮টি। নদী অববাহিকায় বসতি গড়ে তুলেছে প্রায় ৩৩ কোটি মানুষ।
বাংলাদেশ গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতের নদ-নদীসমূহের সঙ্গমস্থল। উত্তর ভারত আর আসামের বিস্তীর্ণ ভূমি পেরিয়ে উপনদী-শাখানদীসমূহ নিয়ে নেমে এসেছে বাংলাদেশের বৃহৎ নদীসমূহ। এদের মধ্যে গঙ্গা, তিস্তাসহ ৫৪টি নদ-নদীর উৎপত্তিস্থল ভারতে (দু’একটি বাদে) এবং ৩টি মিয়ানমারে। তাই পানি ভাগাভাগি বলি আর বণ্টন বলি সবকিছুই ভারতের সাথে সম্পাদিত হয়েছে বা হবে। ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর তৎকালীন সরকার ‘পদ্মা পানি বণ্টন’ চুক্তি সম্পাদন করলেও তিস্তা চুক্তি এখনও ঝুলে আছে। ভারত বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচ প্রকল্পের জন্য বালাদেশে প্রবাহিত নদীগুলোর উজানে অসংখ্য বাঁধ-ব্যারেজ দিয়ে ভিন্নখাতে একতরফাভাবে পানি প্রত্যাহর করছে; যা আন্তর্জাতিক নদী আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। অভিন্ন নদীর পানি ব্যবহার সংক্রান্ত ১৯৬৬ সালের হোলসিংকি নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রতিটি অববাহিকাভূক্ত রাষ্ট্র অভিন্ন নদীগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অবশ্যই অন্য রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রয়োজন বিবেচনায় নেবে। ১৯৯৭ সালের জাতিসংঘের জলপ্রবাহ কনভেনশন অনুযায়ী প্রণীত আইনে বলা হয়েছে, নদীকে এমনভাবে ব্যবহার করা যাবে না, যাতে অন্য দেশ মারাত্মক ক্ষতি বা বিপদের সম্মুখিন হবে। যেসব নদী দুই বা ততোধিক দেশের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেসব নদীকে আন্তর্জাতিক নদী বলে। সে ধারায় গঙ্গা একটি আন্তর্জাতিক নদী। ফারাক্কা বাঁধ পয়েন্টে গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী পর্যায়ে ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর গঙ্গা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের পক্ষে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের পক্ষে এইচ ডি দেবে গৌড়া নয়া দিল্লির হায়দারাবাদ হাউজে ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষর করেন; যা ১ জানুয়ারি ১৯৯৭ থেকে কার্যকর হয়। চুক্তি অনুযায়ী বছরের শুষ্ক মৌসুমে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মে ১৯৯৭ পর্যন্ত গঙ্গার ফারাক্কা পয়েন্টে উভয় দেশের মধ্যে নি¤েœর ফর্মুলা অনুযায়ী পানি বণ্টিত হবে- ফারাক্কায় পানির প্রাপ্যতা যদি ৭০ হাজার কিউসেক অথবা তার চেয়ে কম হয় তবে বাংলাদেশ পাবে শতকরা ৫০ ভাগ এবং ভারতের অংশ ৫০ ভাগ। পানি যদি ৭০ হাজার থেকে ৭৫ হাজার কিউসেক হয় বাংলাদেশ পাবে ৩৫ হাজার কিউসেক এবং ভারতের অংশ ‘প্রবাহের ভারসাম্য অনুযায়ী’। আর পানি প্রবাহ যদি ৭৫ হাজার কিউসক অথবা তার বেশি হয় তবে বাংলাদেশ পাবে ‘প্রবাহের ভারসাম্য অনুযায়ী’ এবং ভারতের অংশ ৪০ হাজার কিউসেক। প্রতিবছর চুক্তি অনুযায়ী শুষ্ক মৌসুমের মার্চ মাসের ১১ তারিখ থেকে মে মাসের ১০ তারিখ পর্যন্ত প্রতি ১০ দিন অন্তর অন্তর ছয়টি পর্যায়ে উভয় দেশ কমপক্ষে ৩৫ হাজার কিউসেক পানি লাভ করার গ্যারান্টি অর্জন করেছে। চুক্তিটি ৫ বছর অন্তর অন্তর রিভিউ হবে। যদি প্রয়োজন হয় অর্থাৎ কোন সরকার চাইলে অন্তবর্তীকালীন বা দুই বছর পর রিভিউ করতে পারবে। তবে ফারাক্কা পয়েন্টে যদি কোন কারণে গঙ্গার পানি প্রবাহ ৫০ হাজার কিউসেকের নিচে নেমে যায় সেক্ষেত্রে উভয় দেশ জরুরি ভিত্তিতে আলাপ-আলোচনার মধ্যদিয়ে পারস্পরিক সমঝতা; কারো কোনো প্রকার ক্ষতি না করে সমতার নীতিতে গঙ্গার পানি বণ্টন করে নেওয়ার অঙ্গীকার করেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না, বাংলাদেশ ৩৫ হাজার কিউসেক কেন শুষ্ক মৌসুমে চুক্তির অর্ধেকও পানি পাচ্ছে না। ভারত ৫ বছর অন্তর অন্তর রিভিউতো দূরে থাক বিগত ২৬ বছরে একবারও রিভিউ কেরেনি। অথচ ফারাক্কার উজানে বর্তমানে পানি থৈথৈ করছে। ভারত উল্টো গঙ্গা কেন্দ্রিক বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। উত্তর প্রদেশের কানপুরে গঙ্গা নদীর উপর নির্মাণ করছে ‘লব-কুশ’ ব্যারেজ। এই বাঁধ দিয়ে তারা প্রতিদিন ১৯ হাজার মিলিয়ন লিটার পানি সরিয়ে নিচ্ছে। ‘আপারগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’, ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ এবং ‘নিন্মগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট’ নামে তিনটি খাল-খনন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। আপারগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট-এর মাধ্যমে প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার ক্যানেল তৈরী করে ৩ লাখ ৩৩ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে সেচ দেওয়ার ব্যবস্থা করছে। ‘মধ্যগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট-এর মাধ্যমে ১ হাজার ৬০০কিলোমিটার এবং নিন্মগঙ্গা ক্যানেল প্রজেক্ট-এর মাধ্যমে ৬ হাজার কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে খাল খনন করে সেচকার্য চালিয়ে যাচ্ছে। ২০০৫ সালে ভারত উত্তর প্রদেশে তেহারি-গাড়ওয়াল জেলায় গঙ্গা নদীর ওপর তেহারি ড্যাম নির্মাণ করেছে। এই ড্যামে বিপুল পানি জমিয়ে রেখে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সেচের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। তেহারি ড্যাম নির্মাণের পর থেকে ভাটিতে বিশেষকরে হরিদ্বার বাঁধ ও ফারাক্কা বাঁধ পয়েন্টে পানির প্রবাহ অনেকটা হ্রাস পায়েছে। এদিকে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার গঙ্গা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে উজানে আরো ১৬টি বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এ ধরনের পরিকল্পনা গ্রহণ করলে ভাটির বাংলাদেশ এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের সম্মুখিন হয়ে পড়বে। বৈশি^ক ও ভারত সৃষ্ট এই প্রভাবের ফলে উত্তর জনপদে জলবায়ুর অস্বাভাবিকতা, চরমভাবপন্নতা, মরুকরণ, অসময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অসময়ে বন্যা-বৃষ্টি, চর জাগা, স্থায়ী জলাবদ্ধতা, শিলাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঝড়, বন্যা, খরা, নদী ভাঙন এ অঞ্চলে নিত্য ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার ‘ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’ শীর্ষক পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বরেন্দ্র অঞ্চলকে ডেল্টা অঞ্চলের একটি ‘হটস্পট’ সংবেদনশীল অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত করেছে। তিস্তা-ফারাক্কা প্রভাবে উত্তর-পূর্বে তিস্তা-যমুনা এবং আত্রাই-করতোয়ার পলি অঞ্চল আর পশ্চিম-দক্ষিণে মহানন্দা-পদ্মার মধ্যবর্তী ভূ-ভাগের প্রায় ৮ হাজার ৪০০ বর্গ কিমি এলাকা এখন হুমকির মুখে। এ অঞ্চলে প্রায় ৮ হাজার গভীর নলকূপ এবং প্রায় ৫০ হাজার অগভীর নলকূপ শুষ্ক মৌসুমে পানি পাচ্ছে না। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত দেশের সকল অঞ্চলের চেয়ে অনেক কম; যেখানে দেশের অন্য অঞ্চলে বাৎসরিক গড় বৃষ্টিপাত ২ হাজার থেকে ৪ হাজার ৫০০ মিমি হতে দেখা যায় সেখানে বরেন্দ্র অঞ্চলে ৭৫০ থেকে ১ হাজার ৪০০ মিমি। পরিবেশ বিজ্ঞানীগণ মনে করেন, এ অবস্থা দীর্ঘায়ু হলে ‘সেকালের সম্পদশালী আফ্রিকা আর আজকের দুর্ভিক্ষ পীড়িত আফ্রিকার’ মত হবে উত্তর জনপদ। কৃষিপ্রধান অঞ্চলে একদিকে যেমন প্রাকৃতিক সম্পদ হ্রাস, পানি সম্পদ, মৎস্য সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে তেমনি জীবন-জীবীকার উৎস ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে। এভাবে চলতে থাকলে অর্থাৎ জীবনোপকরণ হ্রাস, খাদ্য হ্রাস, স্বাস্থ্যঝুঁকি, অপুষ্টি, রোগব্যধি, সামাজিক অবক্ষয়, অর্থনৈতিক ক্ষতির মধ্যে শুধুমাত্র উত্তর জনপদই নয় আগামীর বাংলাদেশও পতিত হবে এ কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা যায়।[ লেখক: নদী কর্মী, সভাপতি- রিভারাইন পিপল, পাবনা।]


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *