।। ড. মো. মনছুর আলম।।
বাংলাদেশ ও ভারতে ‘বলেশ্বর’ নামে তিনটি নদীর সন্ধান পাওয়া যায়। ভারতের আসাম রাজ্যের মহিপুর ও কাছাড় জেলার সুরমা নদীর উজান প্রবাহপথের নাম ‘বরাক নদী’। এই বরাক নদী বাংলাদেশের সিলেটের সমভূমিতে এসে স্থানভেদে কোথাও কোথাও বলেশ^র নদী নামে পরিচিতি পেয়েছে। এছাড়া বরাক নদী স্থানভেদে কালনী, ভেড়ামোহনা ও মেঘনা নামেও পরিচিত। কুষ্টিায়া জেলার গড়াই নদী ক্রমাগত দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হতে হতে অনুরূপভাবে বলেশ্বর নাম ধারণ করেছে। এছাড়া গড়াই নদী ক্রমাগত দক্ষিণে প্রবাহিত হতে হতে মধুমতী ও কচা নামেও পরিচিতি পেয়েছে। মূলত মধুমতী ও শালদাহ্ নদীর সম্মিলিত স্রোত বলেশ্বর নদী তৈরী করেছে; যা খুলনা জেলার দক্ষিণভাগ দিয়ে প্রবাহিত। যাবার পথে সুপ্তি ও ভোলা নামে দুটি শাখা নদীর জন্ম দিয়ে বঙ্গোপসাগরের পতিত হয়েছে। অবশ্য বঙ্গোপসাগরের মোহনায় গিয়ে এই নদীর নাম হরিণঘাটা হয়েছে। অপর বলেশ্বর নদী অর্থাৎ আমাদের আলোচিত বলেশ্বর নদী পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার একটি ইতিহাস-ঐতিহ্যম-িত নদী। পাবনা ‘বলেশ্বর নদী’ একটি ছোট নদী হলেও বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিধন্য নদী হিসেবে এর মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে নদীটি তাঁর ঐতিহ্য ধরে রাখতে না পারলেও কবিগুরুর ইতিহাস-ঐতিহ্য ধরে রেখেছে যুগ যুগ ধরে।
পাবনা বলেশ্বর নদী বড়াল নদীর একটি শাখা নদী; যা বড়াল থেকে উৎপত্তি এবং চয়ড়া অধীননগর হুরাসাগর নদীতে নিপতিত হয়েছে। দৈর্ঘ্য প্রায় ১২ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ প্রায় ৫০ মিটার। নদীর ধরন বা বৈশিষ্ট্য সর্পিলাকার। এটি একটি মৌসুমি প্রকৃতির নদী। নদীর গভীরতা ৩.৫ মিটার এবং অববাহিকা অঞ্চল ১৩০ বর্গ কিলোমিটার। প্রবাহমান বড়াল নদীর চড়াচিথুলিয়া থেকে উৎপত্তি হয়ে পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে মোনামারা-বিলকলমি হয়ে চিনানাড়ির দিকে আগ্রসর হয়েছে। অতঃপর চিনানাড়ি থেকে হাঁড়িয়া গ্রামের পাশ দিয়ে অগ্রসর হয়ে পাটগাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পাটগাড়ি বড় ব্রিজের নিচ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আরো পূর্বদিকে অগ্রসর হয়ে চয়ড়া গ্রামের দক্ষিণ দিয়ে ‘সূতি খালি’ বিলের মধ্যদিয়ে অগ্রসর হয়ে চয়ড়ার পূর্বপ্রান্তে অধীন নগর (বেড়া বেঙ্গল জুট মিলের পাশে) হুরাসাগর নদীতে নিপতিত হয়েছে।(ড. মো. মনছুর আলম, ইছামতি নদীর পূর্বাপর, পৃ. ৪৯)।
বলেশ্বর নদী এক সময় অত্যন্ত প্রবাহমান ও স্রোতস্বীনি নদী ছিল। নদীর চরিত্রও ছিল বিচিত্রধর্মী। নদী পাড়ের বাসিন্দা আমাইকোলা গ্রামের মো. ফজলাল হোসেন (৬৫) এবং নূর মোহাম্মদ (৭৫) এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আপনারা এখন যে বলেশ্বর নদী দেখছেন পূর্বে কিন্তু এই নদী এমন ছিল না। বলেশ^র নদী অনেক স্রোতস্বীনি নদী ছিল। পূর্বে হুরাসাগর নদীর প্রচ- পানির চাপ মুজিব বাঁধ সামলাতে না পেরে বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে ভেঙে যেত এবং পানি প্রচ- বেগে তর্জন-গর্জন করতে করতে এই বলেশ্বর নদী দিয়ে ঢুকে সমগ্র এলাকা প্লাবিত করতো। তবে বর্ষা মৌসুমে নদীতে স্রোত বা তর্জন-গর্জন থাকলেও কোন ভাঙন সৃষ্টি করতো না। নদী পাড়ের বাসিন্দাদের জন্য দুঃখ-দুর্দশার কারণ হয়ে দাঁড়াতো না। বলেশ^র নদীকে অনেকে ‘সূতিখালি নদী’ বলে ভুল করেন। আসলে ‘সূতিখালি’ একটি বিলের নাম; যা বলেশ^র নদীর শেষ প্রান্তে অবস্থিত। সাঁথিয়া উপজেলার পাটগাড়ি গ্রামের পূর্বে, শাহজাদপুর উপজেলার চয়ড়া গ্রামের দক্ষিণে, সাঁথিয়া উপজেলার আমাইকোলার পশ্চিমে এবং ভিটেপাড়ার উত্তরে ‘সূতিখালি’ বিলের অবস্থান।
বলেশ্বর নদীর বক্ষে এক সময় ছোট-বড় অনেক নৌকা, লঞ্চ, স্টিমার চলাচল করত। বিশ^কবি রবীনাথ ঠাকুরের অনেক স্মৃতি জড়িত এই নদীর সাথে। তিনি তাঁর জমিদারি দেখাশোনা করতে বজরা নিয়ে অনেক সময় ইছামতি নদী থেকে সোজা পথে হলুদঘর বড় জোলা এবং সোনাতলা বড় জোলা দিয়ে ঢুকে বলেশ্বর নদীতে যেতেন। বলেশ্বর নদী হয়ে শাহজাদপুর জমিদারি দেখাশোনার জন্য যাতায়াত করতেন। বিশ^কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর বিভিন্ন লেখায় শাহজাদপুর অঞ্চলের নদ-নদী এবং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে ৩ আষাঢ় ১২৯৮ (১৬ জুন ১৮৯১) সালে শাহজাদপুর কাছারি বাড়ি থেকে ইন্দিরা দেবীকে লেখা পত্রে এ এলাকর নদী এবং প্রকৃতির সুন্দর বর্ণনা পাওয়া যায়। এছাড়া ২৩ জুন ১৮৯১ তারিখে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ এলাকার নদী ও প্রকৃতির সৌন্দর্য তুলে ধরে ইন্দিরা দেবীবে লেখেন, “আজকাল দুপুর বেলাটা বেশ লাগে। রৌদ্রে চারিদিক বেশ নিঃঝুম হয়ে থাকে-মনটা ভারি উড়– উড়– করে, বই হাতে নিয়ে আর পড়তে ইচ্ছে করে না। তীরে যেখানে নৌকা বাধা আছে সেইখান থেকে এ রকম ঘাসের গন্ধ এবং থেকে থেকে পৃথিবীর একটা গরম ভাপ গায়ের উপরে এসে লাগতে থাকে- মনে হয় যেন এই জীবন্ত উত্তপ্ত ধরণী আমার খুব নিকট খেকে নিঃশ্বাস ফেলছে- বোধ করি আমারো নিঃশ্বাস তার গায়ে গিয়ে লাগছে। ছোট ছোট ধানের গাছগুলো বাতাসে ক্রমগত কাঁপছে- পাতিহাঁস জলের মধ্যে নেবে ক্রমাগত মাথা ডুবাচ্ছে এবং চঞ্চু দিয়ে পিঠের পালক সাফ করছে। আর কোন শব্দ নেই, কেবল জলের বেগে বোটটা যখন ধীরে ধীরে বেঁকতে থাকে তখন কাছিটা এবং বোটের সিঁড়িটা এক রকম করুণ মৃদু শব্দ করতে থাকে। অনতিদূরে একটা খেয়াঘাট আছে। বটগাছের তলায় নানাবিধলোক জড়ো হয়ে নৌকার জন্য অপেক্ষা করছে- নৌকা আসামাত্রই তাড়াতাড়ি উঠে পড়ছে-অনেক্ষণ ধরে এই নৌকা পারপার দেখতে বেশ ভালোই লাগে। ওপারে হাট, তাই খেয়া নৌকায় এতো ভীড়। কেউবা ঘাসের বোঝা, কেউবা চুপড়ি, কেউবা একটা বস্তা কাঁধে ক’রে হাটে যাচ্ছে এবং হাট থেকে ফিরে আসছে-ছোট নদীটি এবং এবং দুই পারের দুই ছোট গ্রামের মধ্যে নিস্তব্ধ দুপুরবেলায় এই একটুখানি কাজকর্ম, মনুষ্যজীবনের এই একটুখানি স্রোত, অতি ধীরে ধীরে চলছে।” (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ছিন্নপত্র, ৭৯-৮০)।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে এ অঞ্চলের ঘি-দুধ ও দুগ্ধজাত দ্রব্য পেয়ে বসেছিল। তিনি শিলাইদহ হতে পদ্মা নদী থেকে ইছামতি নদী হয়ে সোজাপথে সোনাতলা বড় জোলা দিয়ে বলেশ্বর নদীতে ঢুকতেন। অতঃপর বলেশ্বর নদী থেকে সোজা বড়াল নদী ধরে ফুলজোড় নদী দিয়ে শাহজাদপুর কাছারি বাড়িতে যেতেন। যাত্রাপথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সোনাতলা বাজার থেকে দুগ্ধজাত খাদ্য যেমন ঘি, মিষ্টি, দই কিনেছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায়।(ড. মো. মনছুর আলম, ইছামতি নদীর পূর্বাপর, পৃ. ৪৯-৫০)। এ অঞ্চলের দুধ-দই-ঘি শুধু নিজের জন্য নয়, মঝে মধ্যে স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকেও পাঠিয়েছেন। স্ত্রী মৃণালিনী দেবীকে লেখা চিঠি হতে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি লেখেন, “আচ্ছা আমি যে তোমাকে এই শাহজাদপুরের সমস্ত গোয়ালার ঘর মন্থন করে উৎকৃষ্ট মাখন মারা ঘেত্ত, সেবার জন্যে পাঠিয়ে দিলুম তৎসম্বন্ধে কোন রকম উল্লেখমাত্র যে করলে না তার কারণ কি বল দেখি?” (চিঠিপত্র, ১ম খ-, বিশ্বভারতী, পত্র নং-৮)।
বর্ষা মৌসুমে বলেশ্বর নদীতে হুরাসাগর অধীননগর বাঁধ ভেঙে ঢোকা পানি, সূতিখালি বিলের পানি এবং বড়াল নদী হতে বিভিন্ন জোলা-নালা দিয়ে ঢোকা পানি; এই সম্মিলিত পানির প্রচ- স্রোতধারা বুকে ধারণ করে চয়ড়া, ভিটাপাড়া, আমাইকোলা, শরিষা, সোনাতলা, পাটগাড়ি, হাঁড়িয়া, সেলন্দা, মটকা, এলেঙ্গা, খিদিরগ্রাম, হলুদঘর, ধোপাদহ্, পোরাট, সলঙ্গী, মোনমথপুরসহ অত্র এলাকার বিলসমূহে (সূতিখালি বিল, ক্ষুদে বিল, দীঘা বিল, কাজলা বিল, ভোমরা বিল) নিয়ে ছেড়ে দিত। এই বিলসমূহ আবার উক্ত পানি বিভিন্ন জোলা-নালার মাধ্যমে ইছামতি নদীতে ঢেলে দিত। এভাবে দুই/তিন মাস পানি দেওয়া-নেওয়ার খেলা চলত। বর্ষা মৌসুমে বলেশ^র নদীর পানিতে অত্র এলাকা তলিয়ে যেত, তবে আশার কথা হলো পানির সাথে ব্যাপক পলিমাটি ও দেশি মাছের সমাগম ঘটতো। ফলে অত্র এলাকার মাঠ-ঘাট সোনার ফসলে ভরে উঠতো এবং পর্যাপ্ত স্বাদু পানির মাছের সমাগম ঘটতো। বর্তমানে পাবনা জেলার অন্যান্য ছোট নদীগুলোর মত এ নদীটিও মৃতপ্রায় অবস্থা। নদীটি তা পূর্বের জৌলুস হারিয়েছে। কবিগুরুর স্মৃতিধন্য বলেশ^র নদীতে তার পূর্বের পানিপ্রবাহ ফিরে আসুক, ফিরে পাক তার পূর্ণযৌবন- এই প্রত্যাশা।[ লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক, সভাপতি- সাহিত্য ও বিতর্ক ক্লাব পাবনা।]