।। মাঝহারুল আমিন শুভ ।।
স্বাধীন গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধে ষড়যন্ত্র চলে আসছে শুরু থেকেই। প্রতি বছরই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে নির্যাতনের শিকার হন সংবাদকর্মীরা। বাংলাদেশেও সাংবাদিকদের গুম-হত্যা ও হামলার ঘটনা ঘটে প্রায়ই। এছাড়াও মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলায় গণমাধ্যমকর্মীদের হাজতবাসের গল্প সবারই জানা।
এমন বিভিন্ন ঘটনায় বাংলাদেশে স্বাধীন গণমাধ্যমের বিচরনের জায়গা যেন দিন দিন ছোট হয়ে আসছে। অপরাধী, প্রতারক এমনকি দুর্নীতিবাজরাও সংবাদ প্রচার বন্ধে চাঁদাবাজির মামলা অথবা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার করছে প্রতিনিয়ত। এসব মামলায় গণমাধ্যমকর্মীদের গ্রেপ্তারের ঘটনাও বেড়েছে কয়েকগুন। আবার কিছু কিছু মামলায় সাংবাদিকদের জেলহাজতে প্রেরণ, এমনকি রিমান্ডেও নেয়া হয়েছে।
গত বছরের শেষ দিকে সীমান্ত জেলা মেহেরপুরে আলোচিত হোটেল আটলান্টিকার ঘটনায় বেশ আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ওই হোটেলে অনৈতিক সম্পর্ক করে ভিডিও ধারণ এবং ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগে এক ব্যাক্তির মামলায় পুলিশ অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করেন হোটেল মালিক, তার ছেলেসহ এক নারীকে। ওই নারীর দেয়া তথ্য অনুযায়ী গ্রেপ্তার হন এই চক্রের মূলহোতাসহ আরও বেশকজন। চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে ৪ গণমাধ্যমকর্মীসহ এক আইনজীবীর নাম পাওয়া গেছে। বেশকিছু গণমাধ্যমে এই সংবাদ প্রচারও হয়। এসব সংবাদে তুলে ধরা হয়, প্রতারক নারী চক্রটি বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে ওই হোটেলে অনৈতিক সম্পর্কের ভিডিও বা ছবি ধারণ করে। পরে হোটেল মালিক, তার ছেলেসহ বেশকজন ওই ভিডিও বা ছবি ছড়িয়ে দেয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করতেন।
মেহেরপুর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বর্ণালী রানীর আদালতে ওই মামলায় গ্রেপ্তার ছন্দা খাতুন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দীতে বলেন, হোটেল আটলান্টিকায় বেসরকারি টেলিভিশন বাংলাভিশনের মেহেরপুর জেলায় কর্মরত তুহিন অরন্য, ডিবিসি নিউজের মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি আবু আক্তার করণ, দেশ টিভির মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক রেক্সোনা, এশিয়ান টিভির মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি মিজানুর রহমান জনি ও ফয়সাল নামে এক ব্যাক্তির সামনে তাকে ডেকে নিয়ে যায় হোটেল মালিকের ছেলে মামুন। সেখানে হোটেল মালিক মতিয়ার এবং ওই সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে ছন্দা খাতুনকে তার অনৈতিক সম্পর্কের একটি ভিডিও দেখান হোটেল মালিকের ছেলে মামুন ও দেশ টিভির মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক রেক্সোনা। এরপর তার কাছে টাকা দাবি করে মামুন ও রেক্সোনা। সেখানে উপস্থিত অনান্য সাংবাদিকদের কোন ভুমিকা জবানবন্দীতে না বললেও, ছন্দা খাতুন দাবি করেন ওই সাংবাদিকরা এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত।
১৬৪ ধারায় জবানবন্দীতে ছন্দা আরও জানান, ২০২২ইং সালের অক্টোবরে ডিবিসি নিউজের মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি আবু আক্তার করণ তাকে বাংলাভিশনের মেহেরপুর জেলায় কর্মরত তুহিন অরন্যের অফিসে ডাকেন। যেখানে আগে থেকেই উপস্থিত ছিলেন, মেহেরপুর জেলা আইনজীবী সমিতির নব-নির্বাচিত সভাপতি অ্যাডভোকেট কামরুল হাসান, বাংলাভিশনের মেহেরপুর জেলায় কর্মরত তুহিন অরন্য, ডিবিসি নিউজের মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি আবু আক্তার করণ, দেশ টিভির মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক রেক্সোনা, হোটেল মালিকের ছেলে মামুন ও ফয়সাল। ছন্দাকে তারা জেলার বাইরে নিয়ে যেতে চান।
এর কদিন পর ছন্দাকে চুয়াডাঙ্গায় নিয়ে গিয়ে তার মুঠোফোনের রেকর্ড করা ভিডিও নিয়ে নেয় মামুনসহ আরও ৫ জন। জবানবন্দীতে ওই নারী আরও বলেন, দেশ টিভির মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক রেক্সোনা ও হোটেল মালিক মতিয়ার এই চক্রের মেয়েদের নিয়ন্ত্রণ করতেন। চক্রের অন্যতম প্রিয়া খান, বর্ষা, বিপাশাসহ বেশকজন নারীর সম্পৃক্ততার কথা জবানবন্দীতে তুলে ধরেন ছন্দা খাতুন। ছন্দা খাতুনের জবানবন্দীর বরাত দিয়ে পুলিশ এসব তথ্য জানায়।
ছন্দা খাতুনের জবানবন্দী এবং পুলিশের বিবৃতি অনুযায়ী জঘন্য এই অপরাধে হোটেল মালিক মতিয়ার, তার ছেলে মামুন, প্রিয়া খান, দেশ টিভির মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক রেক্সোনা, বাংলাভিশনের মেহেরপুর জেলায় কর্মরত তুহিন অরন্য, ডিবিসি নিউজের মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি আবু আক্তার করণ ও ফয়সাল নামের এক ব্যাক্তিসহ অনেকে সরাসরি জড়িত। কিন্তু কোথাও এশিয়ান টিভির মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি মিজানুর রহমান জনির সম্পৃক্ততার কোন সুনির্দৃষ্ট তথ্য- প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এরপরও ২০২২ইং সালের ২৯ নভেম্বর এশিয়ান টেলিভিশনের জেলা প্রতিনিধি মিজানুর রহমান জনিকে গ্রেপ্তার করা হয়। কয়েক দফা নামঞ্জুর হয় তার জামিন আবেদন। শুধু তাই নয়, নেয়া হয়েছে রিমান্ডেও।
এই মামলায় জনিকে গ্রেপ্তার দেখাতে আদালতে মেহেরপুর জেলা গোয়েন্দা শাখার উপ-পুলিশ পরিদর্শক মো. আশরাফুল ইসলামের এক আবেদনে বলা হয়, ছন্দার জবাববন্দীর ভিত্তিতে আটক জনিকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো প্রয়োজন। কিন্তু আবেদনের শেষে উপ-পুলিশ পরিদর্শক মো. আশরাফুল ইসলাম আসামী মো. রাজন নামের এক ব্যাক্তিকে শোন অ্যারেস্টের আর্জি জানান। অথচ বিজ্ঞ বিচারক সে বিষয়টি খেয়াল না করে মিজানুর রহমান জনিকে কারাগারে পাঠান। কিন্তু যাদের সরাসরি জড়িতের তথ্য পাওয়া গেছে সেই সাংবাদিক রেক্সানা, তুহিন অরন্য, আবু আক্তার করণরা রয়েছেন বহাল তবিয়তে। তাদের গ্রেপ্তার করা দুরের কথা, জিজ্ঞাসাবাদের বিষয়েও কোন প্রকার মাথা ব্যাথা নেই পুলিশ বা বিচার বিভাগের। এমনকি গোয়েন্দা শাখার উপ-পুলিশ পরিদর্শক মো. আশরাফুল ইসলামের আবেদনের কোথাও ছন্দা খাতুনের জবাববন্দী অনুযায়ী সরাসরি সম্পৃক্ত কারও নাম উল্লেখ বা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কোন আর্জি জানানো হয়নি।
বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয় এশিয়ান টিভির মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি মিজানুর রহমান জনির সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ঘেঁটে বেশকিছু তথ্য পাওয়ার পর। গত বছরের ৪ ডিসেম্বর ফেইসবুকে জনির আইডি থেকে দেয়া এক পোস্টে দেখা যায়, হোটেল আটলান্টিকার ঘটনায় সংবাদকর্মীদের ফাঁসানোর চক্রান্ত তিনি আগেই আঁচ করতে পেরেছিলেন। পরের দিন ৫ ডিসেম্বর মেহেরপুর প্রেস নামে ফেইসবুক পেইজের একটি সংবাদ শেয়ার করেন এই সাংবাদিক। যেখানে এই প্রতারক চক্রের চাঞ্চল্যকর সব তথ্য উঠে আসে। এই চক্রের ফাঁদে পড়া এক ভুক্তোভোগীর দেয়া বিভিন্ন তথ্য ও প্রমাণ ওই সংবাদে তুলে ধরেন জনি। নিজের হোয়াটসঅ্যাপে আলাপচারিতায় সবকিছু জানার পর ওই ভুক্তোভোগীকে মেহেরপুর পুলিশ সুপারের কাছে বিষয়টি জানানোর পরামর্শ দেন তিনি।
মেহেরপুর ডিবি ওসি সাইফুল ইসলামের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে সাংবাদিক জনির বিভিন্ন আলাপচারিতায় দেখা যায়, ভয়াবহ এই চক্রের অপরাধ তুলে ধরতে সংবাদ প্রস্তুতের জন্য তথ্য সংগ্রহ করছিলেন সাংবাদিক জনি। সেই সঙ্গে ডিবি ওসি সাইফুলকে অনুরোধও করেছিলেন ওই ভুক্তোভোগীকে সহযোগিতা করার জন্য। অথচ আশ্চর্যজনকভাবে এশিয়ান টিভির মেহেরপুর জেলা প্রতিনিধি জনিকেই উল্টো এই মামলায় রিমান্ডে নিয়েছে ডিবি। ফাঁসানোর চেষ্টা চলছে পদে পদে। যেখানে ডিবি ওসি সাইফুল ইসলামের সঙ্গে পরামর্শ করে জনি চক্রটির অপকর্মের প্রমাণ সংগ্রহ করছিলো এবং তা ডিবির ওসিকে দিয়ে সাহায্য করছিলো, সেখানে জনিকে উল্টো গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নেয়ার ঘটনায় প্রশ্ন উঠতেই পারে ডিবি ওসি সাইফুল ইসলামের ভূমিকা নিয়ে। তাছাড়া ডিবির উপ-পুলিশ পরিদর্শকের আদালতে দেয়া আবেদনে শুধুমাত্র জনিকে গ্রেপ্তার দেখানো এবং সরাসরি সম্পৃক্তদের বিষয়ে কোন মন্তব্য বা আর্জি না জানানোর পর সন্দেহের তীর ডিবি ওসি সাইফুল ইসলামের দিকেই ছুটে।
পুরো বিষয়টি নিয়ে তাই বিভিন্ন প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে জনমনে। সরাসরি সম্পৃক্ততার তথ্য মিললেও কেন ওই সাংবাদিক বা জড়িতদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না? কেন নামঞ্জুর হচ্ছে জনির জামিন আবেদন? কেনই বা জঘন্য এই অপরাধে জড়িত না হয়েও কারাবন্দী সাংবাদিক জনিকে নেয়া হচ্ছে রিমান্ডে? এসব প্রশ্ন বার বার ক্ষতবিক্ষত করে সাধারণ মানুষের আস্থা।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠন সাংবাদিকদের সঙ্গে ঘটে যাওয়া এসব ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করলেও দেশের বিচার বিভাগ সব সময় স্বচ্ছতার সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীদের ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করেছেন।
দেশের স্বাধীন বিচার বিভাগ নিয়ে সন্দেহ নেই সাধারণ মানুষের মনে। নিপীড়িত মানুষের শেষ ভরসাস্থল এই আদালত। কিন্তু সেই আদালতে সম্প্রতি বিচারক নিয়ে আইনজীবীদের কূটুক্তি, উদ্দেশ্য প্রণোদিত মামলায় গণমাধ্যমকর্মীদের হাজতে পাঠানোসহ জামিন আবেদন নামঞ্জুরের বেশকিছু ঘটনায় নড়বড়ে হয়েছে আস্থার খুঁটি।
লেখক : মাঝহারুল আমিন (শুভ),
যুগ্ম বার্তা সম্পাদক, এশিয়ান টিভি।