১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস; সুবর্ণজয়ন্তীতে পাবনায় নানা আয়োজন

শেয়ার করুন

।। রফিকুল ইসলাম সুইট ।।
১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর এই মহালগ্নে জাতির শ্রেষ্ঠ গৌরব, অহঙ্কার ও আনন্দ উজ্জ্বলতার স্বাক্ষর একটি অনন্য দিন। ১৯৭১ সালের এই দিনে ৩০ লাখ বাঙালির বুকের রক্তে, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি ও অগণিত মানুষের সীমাহীন দুঃখ-দুর্ভোগের বিনিময়ে বাঙালির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন এই বিজয় মুকুট শিরে পরেছিল বাংলাদেশ। সুদীর্ঘ ২৩ বছরের পাকিস্তানিদের অত্যাচার-নিপীড়ন আর সীমাহীন বঞ্চনার শৃঙ্খল ভেঙে বেরিয়ে আসার অমোঘ বাণী বজ্রনির্ঘোষ কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান : ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ স্বাধীনতার সেই মহানায়কের প্রতি বিজয়ের এই দিনে জাতির অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও সালাম। তার সঙ্গে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে জাতি তাদের, যাদের অমূল্য সংগ্রামী জীবনের বিনিময়ে আজ স্বাধীন জাতি হিসেবে বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পেরেছে।

দিবসটি উপলক্ষে পাবনা জেলা প্রশাসন, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, পুলিশ প্রশাসন,পাবনা জেলা পরিষদ, পাবনা জেলা আওয়ামীলীগ, জেলা বিএনপি, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিম্ববিদ্যালয়, সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ, পাবনা মেডিকেল কলেজ, স্বাধীনতা দিবস বিজয় উযাপন পরিষদ, পাবনা পৌরসভা,পাবনা প্রেস ক্লাব, গণশিল্পী, পাবনা থিয়েটার ৭৭ সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন ব্যাপক কর্মসুচী গ্রহন করেছে।
কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে স্বাধীনতার স্মৃতি স্তম্ভ দুর্জয় পাবনায় পুষ্পস্তবক অর্পন, জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ, বর্ণাঢ্য র‌্যালী, আলোচনা সভা, রক্তদান, জাতির শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনা করে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডা ও অন্যান্য উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা অনুষ্ঠিত হবে। হাসপাতাল, জেলখানায় উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হবে।
একাত্তরের পাবনায় মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলী : স্বাধীনতা অর্জনের গৌরব ও বীরত্বের দাবিদার পাবনাবাসী। মুক্তিযুদ্ধে পাবনাবাসীর যেমন রয়েছে বীরত্বের ইতিহাস তেমনি রয়েছে বেদনাহত হত্যাযজ্ঞের করুন কাহিনী। পাবনায় জন্ম গ্রহন করেছেন মুক্তিযুদ্ধের উপ-অধিনায়ক এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার, বিদেশের মাটিতে প্রথম পতাকা উত্তোলন কারী মো: হোসেন আলী, পাবনার তৎকালীন জেলা প্রশাসক মো: নুরুল কাদের খান, আব্দুররব রগা মিয়া, শহীদ আমিনুদ্দিন, শহীদ মওলানা কছিমুদ্দিন, রফিকুল ইসলাম বকুলসহ অসংখ্য দেশ প্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। তেমনী রয়েছে পাবনার কলংক মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা সোবহান, মাওলানা ইসহাকসহ বেশ কিছু কুখ্যাত রাজাকার আলবদর ও নকশাল।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাবনায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। লুণ্ঠন করা হয়েছে হাজার হাজার বাড়ী ঘর বাড়ী, পুড়ানো হয়েছে অসংখ্য, ধর্ষণের সংখ্যা অনেক এসব অপকর্মের অন্যতম হোতা মতিউর রহমান নিজামী, মাওলানা সোবহান, মাওলানা ইসহাক সহ অনেক রাজাকার, আলশামস, আলবদরদের সাথে ছিল পাকিস্তানী আর্মি বাহিনী ও টিপু বিশ্বাসসহ তার নকশাল বাহিনী।
পাবনায় আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিল মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী। পাবনা সদর ডিভিশনের শান্তি কমিটির সেক্রেটারী ছিল মাওলানা আঃ সোবহান। নিজামী ইসলাম দলের দায়িত্বে ছিল মাওলানা ইসহাক।
হত্যা নির্যাতন, লুন্ঠন, ধর্ষণ, আগুনে বাড়ি পোড়ানো অন্যান্য যাদের নাম পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে অন্যতম হল মাওলানা সাইফুদ্দিন এহিয়া, ক্যাপ্টেন আজগর হোসেন জায়েদী, আব্দুল মতিন ঘেটু, ছাত্তার, খন্দকার মাসুদ, রফিকুন্নবী বাবুল, হাসান মাওলানা, আফজাল, আসাদ, বাসেদ রাজাকার, নকশাল টিপু বিশ্বাস, শহীদ, মাসুদসহ আরো অনেকের।
পাবনায় ১৭টি খন্ড যুদ্ধ হয় পাকিস্তানি বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এর মধ্যে অন্যতম হল বেড়া ডাব বাগান যুদ্ধ, পাবনা পুলিশ লাইন যুদ্ধ, দাপুনিয়া যুদ্ধ অন্যতম। এসব যুদ্ধে দেড় শতাধিক পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। কয়েক শ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম নিহত হয়েছিল ২৫ মার্চ রাতে পাবনায় আসা সব পাকিস্তানী আর্মি। প্রথম ১৩ দিনে শত্রমুক্ত ছিল পাবনা জেলা।
পাকিস্তানী বাহিনী রাজাকারদের সহযোগীতায় যে সকল গণহত্যা করেছে তার মধ্যে অন্যতম হল-ডেমরা গণগত্যা, ধুলাউড়ি গণগত্যা, করমজা গণগত্যা, সাতবাড়ীয়া গণগত্যা, আটঘোরিয়া গণগত্যা, সদর ওয়াপদা গণগত্যা, ঈশ্বরদীর পাতিল ভাঙ্গা গণগত্যা, ভুতের বাড়ীর গণগত্যা উল্লেখ যোগ্য।

ডেমরা গণহত্যা : পাবনা ফরিদপুর উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ডেমরা এবং পাশের গ্রাম রুপসী। যেখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলনা বলাই চলে। হিন্দু অধ্যুষিত ডেমড়া ও রুপসীর গণহত্যা এখানে প্রায় ৮০০ মানুষকে হত্যা করা হয়। এখানে ২টি গণকবর দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা এ্যাডভোকেট শামসুল হক নান্নু বলেন ১৪মে শুক্রবার ডেমড়া গণহত্যার অন্যতম নায়ক ছিল মাওলানা নিজামী। দুইদিন আগে হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় এসে তিনি পরিকল্পনা করে যান স্থানীয় রাজাকারদের সাথে। তিনি বলেন, নিজামী,সোবহান, রফিকুন্নবী, হাসান মাওলানা সরাসরি এ হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত ছিল। ঐ এলাকার প্রত্যক্ষদর্শী ওয়াজেদ আলী বলেন এখানে ৮-৯ শত লোককে হত্যা করা হয়েছে। নিজামী এলাকায় রাজাকারদের সংগঠিত করার জন্য প্রায়ই আসতেন। অধিকাংশ মানুষকে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছে। আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে স্বাক্ষ্য দেওয়া বাইসগাড়ী গ্রামের আয়নুল হক মাষ্টার বলেন, পাকহানাদার বাহিনী ডেমরা হিন্দু অঞ্চল চিনত না। এদেশের আলবদর কুখ্যাত রাজাকার বেড়ার আক্কাস আলীর সহায়তায় পাকহানাদার বাহিনী এখানে এসেছিল। তারা যদি সেদিন সাহায্যে না করতো তাহলে ডেমরা এই বর্বরোচিত গণহত্যা হতনা। তিনি আরও বলেন স্বাধীনতার ৪৩ বছর পার হলেও আজ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর আদর্শের বাংলাদেশ গঠিত হয়নি। ডেমরা অঞ্চলে মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। বাউসগাড়ী গ্রামের বীরমুক্তিযোদ্ধা মহির উদ্দিন মাষ্টার বলেন সেদিন ছিল শুক্রবার ভোরে ডেমরা বাজার এর আশপাশে চর্তুদিকে পাকহানাদার বাহিনী ঘিরে ফেলে। এর মধ্যে কোন মতে তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বের হয়ে আমি পাশের গ্রামে অবস্থান নিয়ে সাধারণ মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পাই । পরে আগুনের লেলিহান শিখায় সমস্ত গ্রাম পুরে ছাই হয়ে যায়। হানাদার বাহিনী চলে যাবার পর এসে দেখি সারি সারি লাশ। হিন্দু ধর্মের লোকদের এক সারিতে এবং মুসলমান ধর্মের লোকদের এক সারিতে করে হত্যা করা হয়েছে। পরে নিজ হাতে হিন্দু ও মুসলিম মিলে প্রায় ৮‘শতাধীক মাুনষের শৎকার করি।
হাদল ও কালিকাপুর গণহত্যা : ফরিদ পুর উপজেলার চিকনাই নদীর তীরে প্রত্যন্ত অঞ্চল হাদল ও কালিকাপুর। পাবনা বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখানে নিরাপদ ভেবে অআশ্রয় নিয়েছিল। ১৯৭১ সালের ২৪ মে স্থানীয় রাজাকার হাসান আলীদের সহযোগীতায় পাকিস্তানী বাহিনী হত্যাযঞ্জ চালায় এতে প্রায় ৪ শ লোক মারা যায়।

১২ মে ১৮-২০টি ট্রাকযোগে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগতিায় পাকবাহিনী সুজানগর উপজেলার সাতবাড়ীয়া এলাকায় ১০ ঘন্টাব্যাপী কয়েকটি গ্রাম জালিয়ে দেয়। এ সময় প্রায় ৮শ নারী-পুরুষকে হত্যা করে। এসব লাশ পদ্মা নদীতে ভাসিয়ে দেয় এবং কিছু লাশ গণকবর দেয়।
সাথিয়া থানা থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দুরে ধুলাউড়ি গ্রাম। নিরাপদ ভেবে প্রায় ২শ মুক্তিযোদ্ধা ধুলাউড়ি ও এর আশে পাশের গ্রামে অবস্থান করেছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান টের পেয়ে স্থানীয় রাজাকার নিজামী, হাসান, সাত্তার, আসাদদের সহযোগীতায় ২৭ নভেম্বর শেষ রাতে ধুলাউড়িতে ২১জন মুক্তিযোদ্ধা সহ অনেক গ্রামবাসীকে হত্যা করে পাকসেনারা। ধুলাউড়িতে ২১ জন মুক্তিযোদ্ধার গণকবর রয়েছে। এ যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মাজেদ বলেন, আমার গলায় ছুরী দিয়ে জবাই করে আমি মরার ভান করে পড়ে থাকি। আল্লাহ আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আমি সবসময় স্বাক্ষীদেব, নিজামীর নির্দেশেই এদেশে শতশত লোককে হত্যা করা হয়েছে। মাজেদ আরো জানান, পোষাক ছিল এখনকর মতোই, দাড়ি ছিল কাঁচা হালকা।
সাঁথিয়া সোনাতলায় মুক্তিযোদ্ধা খলিলুর রহমান জানান, ধুলাউড়িতে অনেক লোককে হত্যা করা হয়। অনেকের লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। আমি গাছে উঠে বেঁচে যাই। এযুদ্ধে আরেক পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধা সুজানগরের আঃ মাজেদকে ব্যানেট দ্বারা আঘাত করা হয়। তিনিও সেদিন বেঁচে যান। আব্দুল মাজেদ বলেন- নিজামীর নির্দেশেই সেদিন এই গণহত্যা করা হয়েছে। সাথে ছিল ছাত্তার রাজাকার, হাসান মাওলানা, সোবহান মাওলানা সহ বেশ কিছু রাজাকার।
সাথিয়া এবং বেড়ার মাঝামাঝি করমজা গ্রাম। বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা এখানে অবস্থান করে। তাদের অবস্থান টের পেয়ে স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগীতায় গুলি করে ৯ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেক গ্রামবাসীক হত্যা করে পাকিস্তানীবাহিনী। প্রত্যক্ষদর্শী আমিনুল হক সাাঁথিয়া করমজা বদ্ধভূমির বর্ণনা দিয়ে বলেন-১৯৭১ সালের ৮মে করমজাতে ভোরে ৯জন কে মুক্তিযোদ্ধাসহ অনেক লোককে হত্যা করে পাকিস্তানী বাহিনী। এদের সাথে ছিল নিজামী, রফিকুন্নবী বাবুল, আফজাল, আসাদ বর্তমানে রফিকুন্নবী বাবুল ঢাকার কোটিপতি ক্রিসেন্ট হোল্ডিং এর মালিক, সাবেক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য, ঢাকা মহানগর এর জামাত নেতা।
২৮ মার্চ পাবনা পাবনা টেলিফোন এক্সটেঞ্জের যুদ্ধে পাকিস্তানীকে পরাজিত করা হয়। এসময় পাকিস্তানীর সব আর্মিকে হত্যা করা হয়। এর পর ১০ এপ্রিল আবার পাকিস্তানী বাহিনী পাবনায় আসে। এ ১৩ দিন পাবনা শত্রæ মুক্ত ছিল। এ যুদ্ধে তৎকালীন ডিসি নুরুল কাদের খান মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষ নিয়ে অস্ত্রাগার খুলে দিয়েছিল।
মুক্তিযোদ্ধা কাজী জানান, ১৯ এপ্রিল বেড়া ডাব বাগানে ব্যাপক যুদ্ধ হয় এ যুদ্ধে ২৩ জন মুক্তিযোদ্ধা সহ ১১৭জন মারা যায়। এখানে কয়েকটি বধ্যভূমি রয়েছে। তিনি আরো জানান এলাকায় পরে ক্যাম্প করে এলাকায় প্রায় ৩০০ বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। অনেক মেয়েকে ধরে নিয়ে আসত ক্যাম্পে। এসময় নিজামী, বাবুল, সোবহান, ইসহাকসহ অন্যান্য রাজাকাররা এসকল অপকর্ম চালাত। বর্তমানে ডাববাগানের নামকরণ করা হয়েছে শহীদ নগর।
৭১ সালে ১ রমজান তারিখে সদর উপজেলার তিনগাছা বাবুদের বাগানে নকশাল এর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যদ্ধ হয় এতে নকশালদের ৩৪ জন নিহত হয়। ১৭ রমজান সদর উপজেলা প্রতাপপুর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের আরেকটি যুদ্ধ হয় নকশালদের সাথে সেখানে নিহত হন মুক্তিযোদ্ধা আতিয়ার ও জয়নাল। নকশালদের সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়াবহ যুদ্ধ হয় ২৭ নভেম্বর সানিকদিয়ার চরে। এ যুদ্ধে শহীদ হন মুক্তিযোদ্ধা জাহাঙ্গির আলম সেলিম, আব্দুল হামিদ, শাজাহানসহ বেশ কিছু মুক্তিযোদ্ধা।
১ ডিসেম্বর সদর উপজেলার হেমায়েত পুর ইউনিয়নের নাজিরপুর গ্রামে একইদিনে ৬৬ জন মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী জনতাকে হত্যা করে।
একই পরিবারের ৫ জনের শহীদ হয়েছিলেন-১৯৭১ সালের ৮ ডিসেম্বর সম্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন পাবনা সাধুপাড়ার রোকেয়া বেগমের ছেলে মোশারফ হোসেন রঞ্জু ও মোস্তাক হোসেন অঞ্জু। দুই ভাইয়ের মৃত্যুর সংবাদ জানাতে এবং বাবা মায়ের সঙ্গে দেখা করতে ১২ ডিসেম্বর অপর দুই ছেলে মোকাররম হোসেন মুকুল ও মনসুর হোসেন মঞ্জু এবং ভগ্নিপতি ইউসুফ আলী তাদের ঢাকার মধুবাগের বাসায় গিয়েছিলেন।
সে সময় পাক হানাদারদের দোসর রাজাকার আল বদর ও আল শামসের ক্যাডাররা তাদের আগমনের খবর পাক সেনাদের জানিয়ে দেয়। মুহুর্তেই পাক সেনারা ওই বাড়ি ঘিরে তাদের তিনজনকে ধরে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে হত্যা করে। তবে শহীদ পাঁচজনের কোন লাশই পাইনি তাদের পরিবার।
পাবনা জেলার আওয়ামীলীগ এর সাবেক সাধারন সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা রেজাউল রহিম লাল জানান, পাবনা সদরে ওয়াপদার ওখানে শতশত লোককে হত্যা করে পদ্মায় ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং কিছু লোককে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছে। এসকল অপকর্মের অন্যতম হোতা হচ্ছে নিজামী, সোবহান, ঘেটু রাজাকাররা।
পাবনা সদর উপজেলার চেয়ারম্যান মোশাররফ হোসেন বলেন, ইসহাক মাওলানা তখন আলিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ছিলেন। কাজেই আলিয়া মাদ্রাসায় তখন টর্চার সেল ছিল, সেখানে লোকজনকে নিয়ে গিয়ে হত্যা করত এবং সকল অপকর্মের পরিকল্পনা করত। আলবদর বাহিনীর অন্যতম নেতা মাসুদ খন্দকার এ টর্চার সেলের দায়িত্বে ছিল।
ঈশ্বরদীর বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা শফিক ও শওকত আলী জানান, ঈশ্বরদীতে অনেক জায়গায় অনেক লোককে হত্যা করা হয়েছে, তার মধ্যে রেলষ্টেশনের পাশে ১৮জন, রেলওয়েকলোনীতে ৫০জন, পাতিলখানি বধ্যভূমীতে ২২জন সহ ভূতেরবাড়ী, নাড়িচাপাড়া, সুগারক্যান, তুতফার্ম, আলহাজ্ব ক্যাম্প, এস,এম স্কুলে শতশত লোককে হত্যা করা হয়েছে। এসকল অপকর্মের দায়িত্বে ছিল মতিউর রহমান নিজামী, আব্দুস সোবহান, ইসমাইল, মুজাহিদ, আকমল, কাদের, হারাজ, তসলিম সহ বেশকিছু রাজাকার।
পাবনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ড ইউনিটের সাবেক কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা হাবিবুর রহমান হাবিব জানান, নিজামী, সুবহানরা আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে। পাবনা তার নিজস্ব এলাকা হওয়ায় নিজেই গণহত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগসহ অনেক অপকর্মেও সাথে জড়িত ছিল। সোবহান মাওলানা পাবনা জেলার সকল অপকর্মের তদারকি করেছেন। তিনি আরো জানান, স্কয়ারের মালিক স্যামসান চৌধুরীর জীপ গাড়িটি তিনি ছিনিয়ে নিয়েছিল। এগাড়িতে চড়ে তিনি এসকল অপরাধমূলক অপকর্ম চালিয়েছে। সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দ্রুত করা প্রয়োজন।
সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তযুদ্ধ’৭১ পাবনা জেলা শাখার সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আ স ম আব্দুর রহিম পাকন তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, এইসব যুদ্ধাপোরাধীদের পাশাপাশি নকশালদেরও মুক্তিযোদ্ধা হত্যার দায়ে বিচার হওয়া দরকার। টিপু বিশ্বাস, মাসুদ গং রা অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করেছিল। তিনি বলেন, নিজামী এবং তার দোষররা মুক্তিযুদ্ধের সময় হাজার হাজার মানুষের বাড়ীতে লুটপাট, অগ্নি সংযোগ, গণ হত্যাসহ নানা অপকর্ম চালিয়েছিল।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *