॥ বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. স. ম.আব্দুর রহিম পাকন ॥
পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের জনগণ যখন সোচ্চার, তখন সেই আন্দোলনকে বেগময় করার লক্ষ্যে পাবনা জেলা আওয়ামীলীগের নেতৃবৃন্দও কৃষক, শ্রমিক ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে করে পাবনার জনপদ রেখেছিল তাঁদের দখলে। যার প্রমাণ এই ভুট্টা আন্দোলন। এই আন্দোলন পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র পাবনাতেই সংঘটিত হয়েছিল।
১৯৬৭ সালের ১৬ই মার্চ পাকিস্তানের উপনিবেশিক সরকার কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের জনগণকে হত্যা করার নিমিত্তে দেশের বিভিন্ন স্থানে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিনামূল্যে ভুট্টা বিতরণ করে। সেই ভুট্টা ছিল বিষাক্ত। সেই বিষাক্ত ভুট্টা খেয়ে পাবনার রামচন্দ্রপুরের দিনমজুর আব্দুল গফুর হারু ও তার সহধর্মিনী মৃত্যুবরণ করেন এবং শত শত সাধারন মানুষ অসুস্থ হয়ে পাবনা সদর হাসপাতালে ভর্তি হন। পাবনা সদর হাসপাতাল এলাকা হয়ে ওঠে উত্তাল আর বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত ও নিহতদের পরিবার এবং আত্মীয়-স্বজনের আহাজারিতে পাবনা সদর হাসপাতাল এলাকায় রূপ নেয় এক মর্মান্তিক দৃশ্যের।
এরই প্রতিবাদে পাবনা জেলা আওয়ামীলীগের তৎকালীন সভাপতি মরহুম আমজাদ হোসেন ও আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম আব্দুর রব বগা মিয়া ও জাতীয় নেতা শহীদ এম মনসুর আলী নেতৃত্বে পাবনার অন্যান্য দলের নেতৃত্বদানকারী নেতৃবৃন্দ মরহুম আমিনুল ইসলাম বাদশা (ন্যাপ) মরহুম প্রসাদ রায় (কমিউনিস্ট পার্টি), শ্রী রণেশ মৈত্র (কমিউনিস্ট পার্টি), সাংবাদিক মরহুম আনোয়ারুল হক, আওয়ামীলীগের শহীদ আহাম্মেদ রফিক (যিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগ মনোনীত প্রাদেশিক পরিষদের সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন। নির্বাচিত হবার মাত্র ৫ দিন পর ২২শে ডিসেম্বর ১৯৭০ সালে তার নিজ বাসভবনের সন্মুখে তৎকালীন নকশাল বাহিনী তাকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এই হত্যার সংবাদ পেয়ে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে শেষবারের মতো দেখতে আসেন এবং তাঁর নামাজে জানাজায় অংশগ্রহণ করেন।) সহ পাবনার সকল রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, ছাত্র-জনতা রাজপথে নেমে আসে এবং প্রতিবাদ জানাতে মুসলিম লীগ থেকে মনোনীত জাতীয় সংসদ সদস্য ও সংসদীয় কমিটির খাদ্য বিষয়ক সম্পাদক ক্যাপ্টেন আসগর হোসেন জায়েদীর রূপকথা রোড়ের বাসভবনের সম্মুখে (বর্তমান শহীদ আমিনউদ্দীন আইন কলেজ) প্রতিবাদ কর্মসূচি দেন।
এই অবরোধ কর্মসূচিকে প্রতিহত করার জন্য জায়েদী তাঁর নিজ বাসভবন থেকে আন্দোলনকারীদের উপর গুলি বর্ষণ করে ও পুলিশের মাধ্যমে আন্দোলনকারী নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষদের উপর হামলা চালায়। এ হামলায় প্রায় ৫০ জন আহত হয়। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা শহীদ আহম্মেদ রফিক। বর্তমান আওয়ামী লীগ অফিসের সম্মুখে অবস্থিত ছিল মরহুম খলিল মিয়ার পেট্রোল পাম্প সেখান থেকে শহীদ আহমেদ রফিক ড্রাম ভর্তি পেট্রোল গড়িয়ে নিয়ে জায়েদী বাড়ি রূপকথা গলির দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে শহীদ আহমেদ রফিক পুলিশ কর্তৃক গুলিবিদ্ধ হন এবং জায়েদীর তার বাড়ি থেকে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে শুরু করেন। সেখান থেকে ছোড়া গুলিতে একজন পথচারী ভিক্ষুক গুলিবিদ্ধ হয়ে সেখানেই মৃত্যুবরন করেন। আন্দোলনকারীর এই হামলাকে প্রতিহত করার জন্য পাবনা শহরের বন্দুক ব্যবসায়ী মরহুম কোবাদ আলির বন্দুকের দোকান থেকে আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ করে প্রতিহত করার চেষ্টা করে।
এই আন্দোলনকে ঠেকাতে প্রশাসন তাৎক্ষণিক শহরে কারফিউ দেয় এবং আন্দোলনের নেতৃত্ব দানকারীদের নেতাদের গ্রেপ্তার করতে শুরু করে। গ্রেপ্তারকৃত নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগের অন্যতম সহ-সভাপতি জাতীয় নেতা শহীদ এম মনসুর আলী, তৎকালীন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মরহুম আমজাদ হোসেন, শহীদ এ্যাড. আমিন উদ্দিন, এ্যাড. গোলাম হাসনায়েন, মরহুম আমিনুল ইসলাম বাদশা, প্রয়াত প্রসাদ রায়, শ্রী রনেশ মৈত্র, মরহুম আবু তালেব খন্দকার (তালু চাচা), সাংবাদিক আনোয়াররুল হক, মুহম্মদ নাসিম সহ আরও শতাধিক নেতা কর্মী।
আমি তখন পাবনার রাধানগর মজুমদার একাডেমীর অষ্টম শ্রেণীর ছাত্র। যেহেতু রাধানগর মজুমদার একাডেমি স্কুলটি পাবনা সরকারী এডওয়ার্ড কলেজ সংলগ্ন তাই কলেজ প্রাঙ্গণ থেকে যখন ভুট্টা আন্দোলনের প্রতিবাদ মিছিলটি শহর অভিমুখে রওনা হয় সেই প্রতিবাদ মিছিলে আমি সহ আরো অনেকেই অংশগ্রহণ করেছিলাম। এই আন্দোলনের মাধ্যমেই ১৯৬৭ সালে পাকিস্তানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আমি ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহনের অনুপ্রেরণা পাই ও আমার ছাত্র রাজনীতির কার্যক্রম শুরু হয়।
১৯৬৭ সালে এই ভুট্টা আন্দোলনের পর সামরিক শাসন থেকে বাংলার জনগণকে মুক্ত করার লক্ষে বঙ্গবন্ধুর আহবানে আমি সক্রিয়ভাবে সকল আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল আওয়ামী লীগের ৬ দফা দাবি আদায়ের আন্দোলন, ছাত্রলীগ প্রণীত ১১ দফা দাবি আদায়ের আন্দোলন, ১৯৬৮-৬৯ এর গণ আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আনীত আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তির আন্দোলন, ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সহ সকল আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন। আমার এই সক্রিয় অংশ গ্রহনের কারণে ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত পর্যায়ক্রমে পাবনা জেলা ছাত্রলীগের পাবনা জেলা শাখার ভারপ্রাপ্ত দপ্তর সম্পাদক (১৯৭০), সাংগঠনিক সম্পাদক (১৯৭২) ও সাধারণ সম্পাদক (১৯৭৩-৭৫) পদে দায়িত্ব পাই।
এই ঐতিহাসিক ভুট্টা আন্দোলন ইতিহাস আজ পাবনার মানুষের থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে এই ভুট্টা আন্দোলনের ইতিহাস এখনো অজানা। আমি এই ভুট্টা আন্দোলন সহ স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা আন্দোলনে যারা জীবন বিসর্জন করেছেন তাঁদের প্রতি জানাই বিন¤্র শ্রদ্ধা এবং দাবি রাখছি এই ভুট্টা আন্দোলনের স্মৃতিকে চিরজাগ্রত রাখার জন্য বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের সরকারের প্রতি দাবি জানাচ্ছি পাবনা শহরের রুপকথা রোডে জায়েদীর বাড়ি (বর্তমান শহীদ আমিন উদ্দিন আইন কলেজ) চত্বরে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করার জন্য।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা আ. স. ম.আব্দুর রহিম পাকন
ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক (১৯৭৩-৭৫) ও বর্তমান জেলা আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা।