মামুন হোসেন (পাবনা) : বাংলাদেশ একটি কৃষি প্রধান দেশ। এদেশের শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। মানব সভ্যতার বিকাশের প্রথম থেকেই এদেশের মানুষ কৃষির উপড় নির্ভরশীল। এদেশের কিছু সংখ্যক কৃষক এখনও সনাতন পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে থাকেন। বর্তমানে বেশিরভাগ কৃষক এখন বিভিন্ন আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পূর্বের তুলনায় ফলন বেশি বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। ধান ও পাট বাংলাদেশে প্রধান হলেও গম, চা, আখ, আলু এবং বিভিন্ন শাক সবজি এদেশে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে উৎপাদিত হয়ে থাকে। বাংলাদেশের কর্মসংস্থানে সবচেয়ে বড় খাত জুড়ে আছে কৃষি। দেশের অর্থনীতিতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্য দূরীকরণ মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং খাদ্য নিরাপত্তায় এই খাতের গুরুত্ব অপরীসিম। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেই সাথে মানুষের ঘর বাড়ি নির্মাণ ও দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকান্ডে আবাদি জমির পরিমান দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। এই বর্ধিত জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা পূরণে স্বল্প জমিতে অধিক ফলন নিশ্চিত করতে বিনাধান-১৯ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। বিনাধান-১৯ বছরে ৪ বার আবাদ করা যায় এবং অন্যান্য ধানের চেয়ে অধিক লাভবান হয় কৃষক। তাছাড়া ৪ বার ফলন পাওয়ায় পুষ্টিমানও ঠিকই বিরাজমান থাকে। বর্তমানে পারমাণবিক কৃষি বাংলাদেশের কৃষিখাতে একটি নতুন মাত্রা এনেছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গভেষণা ইন্সটিটিউট (বিনা) বিকিরণ প্রয়োগের মাধ্যমে বিভিন্ন শষ্যের একটি জাত তৈরি করেছে। জাতীয় বীজ প্রত্যেয়ন সংস্থা এগুলোকে কৃষক পর্যায়ে পৌছানোর জন্য অবমুক্ত করেছে। বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গভেষণা ইন্সটিটিউট (বিনা) পাবনা ঈশ্বরদী উপকেন্দ্রের দেওয়া তথ্য সুত্রে জানা যায়, ধান চাষে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে আনার জন্য খড়া সহিষ্ণু আউশ ও আমন ধানের জাত উদ্ভাবনের জন্য সরকার আফ্রিকা রাইস সেন্টার হতে বেশ কিছু সম্ভাবনাময় খড়া সহিষ্ণু ধানের জাত আমদানী করে। এগুলোকে রেডিয়েশন প্রয়োগ ছাড়াও সরাসরি পরিক্ষা নীরিক্ষা করা হয়। এরই অংশ হিসেবে ২০১৩ সালে বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের সহায়তায় জাপান এটমিক এনার্জি এজেন্সি থেকে নেরিকা-১০ ধানের বীজে ৪০ গ্রে মাত্রার কার্বন আয়ন রশ্মি প্রয়োগ করে এন ১০-৪০ (সি)-মিউট্যান্ট সারিটি উদ্ভাবন করা হয়। পরবর্তীতে মিউট্যান্ট সারিটি প্রাথমিক পরীক্ষায় খড়া সহিষ্ণু প্রমাণিত হওয়ায় আউশ ও আমন মৌসুমে বৃষ্টি নির্ভর ও সরাসরি বপন (ডিবলিং) পদ্ধতিতে দেশের খড়াপীড়িত বরেন্দ্র ও পাহাড়ী অঞ্চলসহ বিভিন্ন এলাকায় পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় মিউট্যান্টটি চেক জাত ব্রি ধান ৪৩ ও মাতৃজাত নেরিকা-১০ হতে উচ্চ ফলনশীল ও আগাম পরিপক্ব হওয়ায় ২০১৬ সালে জাতীয় বীজ বোর্ড কতৃক বাণিজ্যিকভাবে কৃষক পর্যায়ে চাষাবাদের জন্য বিনাধান-১৯ নামে অবমুক্ত করা হয়। বিনাধান-১৯ আউশ ও আমন মৌসুমে বৃষ্টি নির্ভর অবস্থায় ডিবলিং পদ্ধতিতে চাষ করা যায়। বিনাধান-১৯ চাষে বীজতলা ও জমি কাদাকরণের প্রয়োজন পড়েনা। জাতটি রোপা আউশ হিসেবেও চাষ করা যায়। বিনাধান-১৯ এর পূর্ণ বয়স্ক গাছের উচ্চতা ৮০-৯০ সেমি। গাছ খাট ও খাড়া বিধায় হেলে পড়ে না। প্রচন্ড খড়ার সময় জাতটির বাড়বাড়তি প্রায় বন্ধ থাকে। আবার যখন বৃষ্টিপাত শুরু হয় তখন দ্রুত বেড়ে স্বাভাবিক ফলন দিতে সক্ষম হয়। বিনাধান-১৯ এর জীবনকাল ৯৫ থেকে ১০৫ দিন পর্যন্ত হয়ে থাকে। খরা প্রবন ও পাহাড়ী এলাকায় ডিবলিং করলে গড় ফলন ৩.৮৪ টন/হে. এবং রোপা হিসেবে ৫.০ টন/হে. ১০০০ ধানের ওজন ২৩ গ্রাম। বিনাধান-১৯ এর চাল সাদা রঙের, লম্বা ও চিকন। চালে আমিষের পরিমাণ শতকরা ২৩.৮ ভাগ। রান্নার পরে ভাত ঝড়ঝড়া হয় ও খেতে সুস্বাদু। বিনাধান-১৯ বৃষ্টি নির্ভর অবস্থায় সরাসরি বপন (ডিবলিং) উপযোগী আউশ ও আমনের একটি জাত। স্বাভাবিকভাবে এ ধানে কোন সেচের প্রয়োজন হয় না। তবে একাধারে বহুদিন বৃষ্টিপাত না হলে অতিরিক্ত খরায় গাছ মারা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে ১-২ টি সেচ দিয়ে গাছ বাঁচিয়ে রাখতে হবে। লবণাক্ত এলাকা ছাড়া দেশের খরা পীড়িত বরেন্দ্র ও পাহাড়ী অঞ্চলসহ সকল উঁচু ও মধ্যম উঁচু জমিতে এ জাতটির ভাল ফলন আশা করা যায়। বেলে দোআঁশ এবং এটেল দোআঁশ জমি বিনাধান-১৯ চাষের জন্য উপযোগী। যে জমিতে পানি জমে থাকে সে সমস্থ জমিতে জাতটি চাষাবাদের উপযোগি নয়। বিনাধান-১৯ খরা সহিষ্ণু জাত হওয়ায় শুষ্ক মাটি বেশি পছন্দ করে।
বিনাধান-১৯ এর বীজ অঞ্চলভেদে আউশ মৌসুমে ১৫ এপ্রিল হতে এপ্রিলের শেষ সপ্তাহ (বৈশাখের প্রথম থেকে মাঝামাঝি) এবং আমন মৌসুমে ১৫ জুলাই হতে ১৫ আগস্ট (১ লা শ্রাবন থেকে ১লা ভাদ্র) পর্যন্ত বপন করা যায়। খরা সহিষ্ণু এ জাতটি বৃষ্টি নির্ভর অবস্থায় সরাসরি সারিতে ও রোপা উভয় পদ্ধতিতে চাষ করা যায়। তবে বেশি ফলন নিশ্চিত করতে হলে ভারি, পুষ্টি ও রোগবালাই মুক্ত বীজ বাছাই করতে হবে। বরেন্দ্র ও পাহাড়ী অঞ্চলসহ যেখানে সেচের পানির অভাব, প্রয়োজন মত বৃষ্টিপাতের অভাবে ধান চাষ ব্যহত হয় সেখানে বিনাধান-১৯ আউশ ও আমন উভয় মৌসুমে ডিবলিং করাই ভালো। সারিতে ১৫ সেমি (৬ ইঞ্চি) পর পর ৫ সেমি (২ ইঞ্চি) গর্ত করে প্রতি গর্তে ২-৩ টি বীজ বপন করতে হবে। সারি থেকে সারির দূরত্ব রাখতে হবে ২০ সেমি (৮ ইঞ্চি)। সেক্ষেত্রে জমির রসের পরিমাণ কম হলে বীজ গজিয়ে নিলে ভালো হয়। প্রচন্ড খরার সময় গাছ পানির কারণে মারা যাওয়ার উপক্রম হলে ১-২ টি হাল্কা সেচ প্রয়োজন হতে পারে। পাঁচ শতাংশ (২০০ বর্গ মিটার) পরিমাণ বীজতলায় ১০ কেজি বীজ ফেলা যায়। আউশ মৌসুমে এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে শেষ সপ্তাহ (বৈশাখের প্রথম হতে দ্বিতীয় সপ্তাহ) এবং আমন মৌসুমে জুন মাসের শেষ সপ্তাহ হতে জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ (আষাঢ়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ হতে শেষ সপ্তাহ) পর্যন্ত বীজতলা তৈরি করে ১৫ থেকে ২০ দিনের চারা রোপণ করলে ভাল ফলন পাওয়া যায়। আউশ মৌসুমে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ হতে শেষ সপ্তাহ পর্যন্ত ১৫ থেকে ২০ দিনের চারা এবং আমন মৌসুমে জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহ হতে আগস্টের শেষ সপ্তাহ (শ্রাবণের ২য় সপ্তাহ হতে ভাদ্র মাসের ২য় সপ্তাহ) পর্যন্ত। বেশি বয়সের চারা লাগালে ফলন কমে যায়। বীজতলায় চারা করার পর লাইন করে রোপণ করলে ফলন বেশি হয়। ৩/৪ টি সুস্থ সবল চারা একত্রে এক গুছিতে রোপণ করতে হবে। সারি হতে সারির দূরত্ব ২০ সেমি এবং সারিতে গুছির দূরত্ব ১৫ সেমি থাকা ভাল। ডিবলিং পদ্ধতিতে চাষাবাদ করলে আগাছার উপদ্রব একটু বেশি হতে পারে। সেক্ষেত্রে ৩-৪ বার আগাছা হাত দ্বারা পরিষ্কার করে সহজেই আগাছা দমন করা যায়। রোগবালাই ও কীট পতঙ্গের আক্রমণ দেখা দিলে নিকটস্থ কৃষি সম্প্রারণ কর্মকর্তার পরামর্শ অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। ভাল ফলন পাওয়ার জন্য সঠিকভাবে ধান কর্তন ও বীজ সংরক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রোগমুক্ত, পরিপুষ্ট ও বিশুদ্ধ বীজ ভাল ফলনের পূর্বশর্ত। এজন্য ক্ষেতের যে স্থানে ভাল ফলন হয়েছে সে স্থান থেকে পূর্বেই ভিন্ন জাতের গাছ তুলে ফেলতে হবে। তারপর ধান কর্তন করে এমন ভাবে মাড়াই ও ঝাড়াই করতে হবে যাতে অন্য জাতের ধান মিশ্রণ ঘটতে না পারে। ধান মাড়াই করার সময় আড়াই বারি দিয়ে যে পুষ্ট বীজ পাওয়া যায় তাই বীজ হিসেবে রাখতে হবে। বীজ ভালোভাবে শুকিয়ে নিয়ে (১২-১৪% আদ্রতার) টিন, প্লাস্টিক অথবা মাটির তৈরি মটকায় উভয় পার্শ্বে এনামেল পেইন্ট দিয়ে ৬ থেকে ৮ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। বীজ সংরক্ষণের পাত্রটি বায়ু নিরোধক অবস্থায় রাখা প্রয়োজন এবং পাত্রটি বীজ রাখার পর ফাঁকা স্থান অন্য কিছু দিয়ে ভরে রাখা প্রয়োজন। তাহলে কীটপতঙ্গের বংশবৃদ্ধি ও পোকার ক্ষতি থেকে বীজ রক্ষা পাবে। এছাড়াও নিম পাতা শুকিয়ে অথবা নিম তেল বীজের সাথে মিশিয়ে রাখলে পোকার আক্রমণ হয় না, ফলে বীজ ভাল থাকে।
এ বিষয়ে পাবনা ঈশ্বরদী বিনা উপকেন্দ্রের এসও এবং ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. খান জাহান আলী বলেন, স্বল্প জীবনকাল ও খড়া সহনশীল হওয়ায় বিনা উদ্ভাবিত উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত বিনাধান-১৯ এর প্রচার ও সম্প্রসারণে লক্ষ্যে আমরা কৃষকদের মাঝে প্রশিক্ষণ দেয়াসহ তাদের বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে আসছি।