আমার স্মৃতিতে তৎকালীন পাবনা জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মরহুম আমজাদ হোসেন

শেয়ার করুন

॥ বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.স.ম আব্দুর রহিম পাকন ॥
৬ই এপ্রিল ১৯৭১ সাল। এই দিনটি ছিল আমার জীবনের একটি বেদনার দিন। ১৯৭৫ সালে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর রাজনৈতিক ও পারিবারিক কারণে আমাকে পিতা-মাতার নির্দেশে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছিল। ১৯৬৭ সাল থেকে তিনিই আমাকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন সৈনিক হিসাবে রাজনীতি করার প্রেরণা দিয়েছিলেন এবং ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধুর আহবানে সাড়া দিয়ে তাঁর তিন সন্তানকে হাসিমুখে মুক্তিযুদ্ধে পাঠিয়েছিলেন। ২০০৪ সালে বিদেশে থাকার কারণে আমি আমার নিজের পিতার মৃত্যুর সময় তাকে শেষ দেখাটা দেখতে পারিনি। কিন্তু পাবনার রাজনীতিতে আমার দুইজন পিতৃতুল্য নেতা ছিলেন। যারা আমাকে সন্তানের মত স্নেহ, ভালবাসা ও পথ প্রদর্শনের মাধ্যমে একজন আদর্শবান রাজনীতিবিদ হওয়ার প্রেরণা যুগিয়েছিলেন। তাঁরা ছিলেন তৎকালীন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ স¤পাদক, বঙ্গবন্ধুর বিশ্বস্ত সহচর মরহুম আমজাদ হোসেন ও মরহুম আব্দুর রব বগা মিয়া। তাঁদের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর আমার সুযোগ হয়েছিল তাঁদের শেষবারের মত দেখার। মরহুম আমজাদ চাচার মৃত্যুটা এমন ছিল তখন তার পরিবারের কেউ তাঁর পাশে উপস্থিত ছিল না। একমাত্র আমি এবং তাঁর ব্যক্তিগত ড্রাইভার সেই মুহূর্তে তার পাশে উপস্থিত ছিলাম।
আজ ৬ই এপ্রিল ২০২২ তাঁর মৃত্যু দিবসকে স্মরণ করে আমার স্মৃতির পাতা থেকে কিছু কিছু উপস্থাপন করছি।
মরহুম আমজাদ হোসেন ১৯২৪ সালের ২১ জুলাই, কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী ইউনিয়নের চর সদিরাজপুর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। পরবর্তীতে তার শ্রদ্ধেয় পিতা মরহুম শেখ রফিক উদ্দিন এবং মাতা পরিজান নেছা পাবনায় এসে নুরপুরে স্থায়ী ভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। তিনি ছিলেন ৪ কন্যা ১ পুত্র সন্তানের পিতা।
তিনি মাদ্রাসার মাধ্যমে শিক্ষাজীবন শুর করেন। পরবর্তীতে তিনি পাবনা জেলা স্কুলে ভর্তি হন এবং রংপুর কারমাইকেল থেকে এসএসসি পাস করে কলকাতা মাওলানা আজাদ কলেজ থেকে এইচএসসি এবং ব্যাচেলার ডিগ্রি লাভ করেন।
কলকাতায় শিক্ষারত অবস্থায়ই তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদীর সং¯পর্শে আসেন এবং সেখান থেকেই তিনি তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন একজন অকুতোভয় সৈনিক এবং ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহন করেন। এই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ারদী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হবার পর আমজাদ চাচাকে তাঁর রাজনৈতিক সচিব হিসাবে কাজ করার সুযোগ করে দেন।
পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি ছিলেন পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি। তিনি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যান্ত আস্থাভাজন এবং বিশ্বস্ত ব্যক্তি। ১৯৬৬ সালের ভুট্টা আন্দোলন, ১৯৬৭ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৮-১৯৬৯ এর গণআন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে আনিতো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সহ পাবনা জেলার সকল আন্দোলন তাঁরই নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল।

তিনি ১৯৬২ সালে সোবাহান মাওলানাকে পরাজিত করে প্রথমবারের মত জাতীয় সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন। পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যে নির্বাচন হয় সেই নির্বাচনে তিনি আবার সোবাহান মাওলানাকে পরাজিত করে দ্বিতীয় বারের মতো জাতীয় সংসদ সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হন।
১৯৬৭ সালে আমার ছাত্র রাজনীতির শুরুর লগ্ন থেকেই তিনি আমাকে সন্তানের মত স্নেহ আদর দিতেন, কেননা আমার বাবার সঙ্গে তাঁর ছিল অত্যান্ত সুসম্পর্ক। এমনকি আমি কোন ভুল বা অন্যায় কাজ করলে আমার বাবা তাঁর কাছে নালিশ করতেও দ্বিধা বোধ করতেন না।
১৯৬৮ সালে ব্যবসায়িক কাজে রাজশাহী যাওয়ার পথে নাটোরের নিকটে তিনি এক সড়ক দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। সেখান থেকে তাঁকে মুমূর্ষ অবস্থায় রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এই সংবাদ পাবনা আসবার পরে পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ সহ তার পরিবারের সদস্যরা অত্যন্ত দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান এবং চিকিৎসার জন্য সকল প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এই বহরে তাদের সঙ্গে আমারও যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল। হসপিটালে যাওয়ার পর নেতৃবৃন্দ সকল সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। হাসপাতালে চাচাকে তাঁর পরিবারের সদস্যদের কাছে রেখে আমরা সবাই পাবনায় ফিরে আসি। এক সপ্তাহ পরে আমি বাবার অনুমতি সাপেক্ষে আমার শ্রদ্ধেয় নেতাকে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দেখতে যাই। সেখানে যাবার পর যে পরিস্থিতি দেখতে পাই তাতে আমি রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাচার সাথে থাকার জন্য মনস্থির করি এবং বাবার অনুমতি চাইলে তিনি আমাকে থাকার অনুমতি দেন। চাচার জ্ঞান আসবার পর আমি চাচীর সঙ্গে আলাপ করি তিনি এখন পাবনায় ফেরত যেতে পারেন। কেননা ৫ কন্যা এবং ১ পুত্র সন্তানদের কে নিয়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে থাকা অতান্ত কষ্টকর। এ ব্যাপারে তারা পারিবারিক ভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে পাবনায় চলে আসেন এবং আমি সেখানে দীর্ঘ প্রায় দুই মাস রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চাচার সঙ্গে অবস্থান করি। এরপর তিনি মোটামুটি সুস্থ হয়ে পাবনায় ফিরে আসেন। ডাক্তারের মতে তাকে এ্যাজমা এবং মর্মান্তিক দুর্ঘটনার কারণে বুকে আঘাত, সহ বিভিন্ন রকম শারীরিক সমস্যা নিয়ে বাকি জীবন অতিবাহিত করতে হবে।
তিনি পাবনায় ফিরে এসে সকল আন্দোলন এবং বঙ্গবন্ধুর নির্দেশিত সকল কর্মসূচি পালনের জন্য নেতৃত্বের আবার হাল ধরেন এবং চাচার নির্দেশনায় অনেক দায়িত্ব আমার কাঁধেও নিতে হয়। যেহেতু প্রায় দুই মাস চাচার চিকিৎসাকালীন সময়ে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আমি তার পাশে ছিলাম এবং কোন সময় কোন ওষুধ তাকে সেবন করতে হবে সেটাও আমার জানা ছিল। সেহেতু চাচি চাচাকে রাতের কোন সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক সভায় আমাকে ছাড়া যাবার অনুমতি দিতেন না।
আরেকজনের নাম উল্লেখ না করলে আমি অকৃতজ্ঞ হব। তিনি হলেন আমাদের শ্রদ্ধাভাজন মনজু ভাই। তিনিও আমজাদ চাচার পরিবারের একজন ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের সামরিক সরকার সকল আন্দোলনের ফলে সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হন। এই নির্বাচনে আওয়ামীলীগের প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন পান আমজাদ চাচা। তিনি তার প্রতিদ্বন্দ্বী সোবহান মাওলানাকে বিপুল ভোটে পরাজিত করেন।
আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেও ভুট্টো-ইয়াহিয়া (সামরিক সরকার) ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে নানান ফন্দি আটেন যে বাঙ্গালীরা যেন ক্ষমতায় না আসতে পারে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ছিলেন অবিচল এবং তিনি

বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করার লক্ষ্যে আন্দোলনের পাশাপাশি পাকিস্তানি সামরিক সরকারের সঙ্গেও আলোচনা চালিয়ে যান।
বঙ্গবন্ধুর আহবানে সকল আন্দোলনকে সফল ও পাবনার রাজপথকে প্রকম্পিত রাখবার জন্য নেতৃত্বে ছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আমজাদ হোসেন ও আব্দুর রব বগা মিয়া চাচা।
তালবাহানার এই আলোচনা চলে ১৯৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত। এই আলোচনা যখন ব্যর্থতায় রূপান্তরিত হয় তখন বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বাংলার জনগণকে সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার লক্ষে এক জনসভার আহ্বান করেন। বঙ্গবন্ধু সেই ঐতিহাসিক জনসভায় সার্বিক পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বাংলার জনগণকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলা সহ সংগ্রাম পরিষদ গঠনের জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান। তিনি তাঁর বক্তব্যের মধ্যে অসহযোগ আন্দোলনেরও ডাক দেন এবং ঘোষণা দেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।
এই ঘোষণার পরপরই পাবনা জেলা আওয়ামীলীগ সহ অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষের দলকে সমন্বয় করে আমজাদ চাচাকে আহবায়ক ও আব্দুর রব বগা চাচাকে যুগ্ন আহবায়ক হিসাবে নির্বাচিত করে পাবনা জেলার সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পরপরই সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ তৎকালীন পাবনার জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের খান ও পুলিশ সুপার চৌধুরী আব্দুল গফফার এর সঙ্গে যোগাযোগ ও বিভিন্ন কৌশল নিয়ে আলোচনা শুরু করেন।
এভাবে আসে ২৫শে মার্চের কালো রাত। পাকিস্তানের সশস্ত্র সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরীহ বাঙালি জাতির উপর। এরপর আমজাদ চাচা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য ও জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারকে সাথে নিয়ে দ্বিপচরে অবস্থান নেন। সেখান থেকেই আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ২৮শে মার্চের যুদ্ধে পাকিস্তানি সেনা বাহিনীকে পরাস্থ করে ২৯শে মার্চ পাবনাকে মুক্ত অঞ্চল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পাবনাকে কিভাবে স্থায়ীভাবে মুক্ত অঞ্চল এর আওতায় রাখা যায় সে জন্য সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেন। সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আমজাদ চাচা কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার তৎকালীন নির্বাচিত সংসদ সদস্য থেকে অস্ত্র নিয়ে এসে পাবনাকে স্থায়ীভাবে মুক্ত অঞ্চল রাখার জন্য দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
৫ই এপ্রিল ১৯৭১, সন্ধ্যায় আমজাদ চাচা মনজু ভাইকে দিয়ে তার পরিবারকে কাশিনাথপুরের দারিয়াপুর গ্রামে নিরাপদ অবস্থানে পাঠিয়ে দেন। ৬ই এপ্রিল ভোরবেলা আমাকে ও চাচার ব্যক্তিগত ড্রাইভারকে সাথে নিয়ে কুষ্টিয়া অভিমুখে রওনা দেবার কথা ছিল। কিন্তু সকালবেলায় চাচা শারীরিকভাবে অসুস্থতা অনুভব করেন। সেজন্য তিনি তাকে চেকআপ করার জন্য পাবনা সদর হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলেন। সেখানে চেকআপ করার পরে কর্তব্যরত ডাক্তার তার অবস্থার অবনতি বুঝতে পেরে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার পর ধীরে ধীরে চাচার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হতে থাকে। অবশেষে বাদ আসর চাচা আমাদের সবাইকে ছেড়ে পরলোক গমন করেন। তাঁর এই হঠাৎ চলে যাওয়ায় আমি ও তার ড্রাইভার শোকে দিশেহারা হয়ে পড়ি। ইতিমধ্যে খবর পেয়ে পাবনা জেলার অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এসে সদর হাসপাতালে উপস্থিত হন এবং চাচার পরিবারকে দারিয়াপুর থেকে ফেরত আনার জন্য ড্রাইভারকে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। চাচার পরিবার পাবনাতে আসলে তাকে যথাযথ মর্যাদায় পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে জানাজার নামাজের পর পাবনা সদর গোরস্থানে আরিফপুরে তাকে দাফন করা হয়। দাফন করার পরে মনজু ভাইয়ের মাধ্যমে চাচার পরিবারকে আটঘরিয়ার অভিরামপুর গ্রামে নিরাপদ স্থানে পাঠানো হয়।
পাবনার রাজনৈতিক ইতিহাসে আমজাদ চাচা ছিলেন একজন আদর্শ নেতা। তিনি ছিলেন অত্যন্ত কর্মী বান্ধব। তিনি আমাকে যে ভালোবাসা দিয়েছেন তার ঋণ আমি কখনোই পরিশোধ করতে পারবোনা। আজকের এই দিনে শ্রদ্ধাভরে তাঁকে স্মরণ করি ও তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করছি।

লেখক বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.স.ম আব্দুর রহিম পাকন।

জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *