।। মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান ।।
সরকারী চাকরীর সুবাদে জেলা শহরগুলো ঘোরার যে সূযোগ আমি পেয়েছি সেটা বোধহয় অন্য কোন চাকরীতে সম্ভব না। আমার আব্বুও সরকারী চাকরীজীবি ছিলেন, এই কারনেই আমার নিজ জেলা শরীয়তপুর হলেও জন্মজেলা খুলনা, লেখাপড়া ক্লাস এইট পর্যন্ত বরিশাল, তারপর ঢাকাতে।
আমার নিজ চাকরীজীবনের শুরু খুলনা থেকে, তারপর ঢাকা, শেরপুর, নারায়নগঞ্জ, কুড়িগ্রাম হয়ে পাবনা। বদলীর চাকরীতে নতুন জায়গায় গিয়ে থিতু না হতেই যেন চলে যাবার সময় হয়ে যায়, বন্ধু তৈরী না হতেই আবার বিচ্ছেদ, মফস্বল শহরগুলোতে যানজট, ধূলার যন্ত্রনা না থাকলেও এখনও সবচেয়ে বড় সমস্যা স্কুল আর চিকিৎসা, আরেকটা সমস্যা প্রটোকলের বাইরে গিয়ে নিজের মত করে কারও সাথে মিশতে না পারা, তবে এর বিপরীত দিক হল, কাজ করতে করতেই অসংখ্য মানুষের সাথে পরিচয় হয়, তাদের কারও কারও সাথে ব্যক্তিগত সখ্যতা তৈরী হয়, যা থাকে আজীবন, একটু হলেও ঠাই পাওয়া যায় অসংখ্যা মানুষের মনের কোঠায়।
আমি সপরিবারে পাবনায় আসি এ বছর জানুয়ারীর ১ তারিখ, এর আগে একবার এসেছি সারদা থাকতে স্টাডি ট্যুরে, দেশের অধিকাংশ মানুষের কাছে পাবনা মানসিক হাসপাতালের জন্য পরিচিত হলেও আমার কাছে পাবনার ল্যান্ডমার্ক পাকশী হার্ডিন্জ ব্রীজ। ১৯৩ বছরের পুরাতন জেলার ১২২ তম পুলিশ সুপার হিসেবে যোগদানের পর প্রথম কয়েক মাস মূলত আমার যাতায়াত ছিল শহর কেন্দ্রিক, সেটা কাজের প্রয়োজনেই, আমার স্বভাবমতই এরপর সূযোগ পেলেই আমি পাবনার আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়াই, প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে আবিষ্কার করি ভরা বর্ষার বিলের রুপ, শরতের নীল আকাশ , দিগন্ত জোড়া সবুজ ধানক্ষেত, শীতে হলুদময় সরিষা ক্ষেত। এতদিনে পাবনার ছোটবড় অনেকের সাথে যে সখ্যতা গড়ে উঠেছে আমার পক্ষ থেকে তা একেবারেই আন্তরিক। আমার কাছে পাবনার সবচেয়ে পজিটিভ দিক এখানকার তরুনদের বিভিন্ন সংগঠন, হেন বিষয় নেই যেটা নিয়ে তারা কাজ করেনা, রক্তদান, শিশু শিক্ষা, পরিবেশ, দুঃস্থদের সহায়তা, ফটোগ্রাফি, গান, ট্যুরিজম নিয়ে অনেক গ্রুপ আছে, যেগুলো শুধু শহর না গ্রামেও ছড়িয়ে আছে, করোনার সময় ওদেরকে এক প্লাটফর্মে নিয়ে আসার চেষ্টা করেছি, সংগঠনগুলোর অনেকেই এখন আমার কাছে পরিচিত, আমিও ওদের কাছে, সোশাল মিডিয়ার কারনে যেখানেই যাই কোন না কোন পরিচিত মুখ পেয়ে যাই, ওরা যখন আগ্রহ নিয়ে কথা বলে , সালাম দেয়, আমার ভাল লাগে; আবার খারাপ লাগে যখন দেখি এত মামলা করার পরও মটর সাইকেলে হেলমেট ব্যবহারে অনীহা, অল্প বয়সীরা তিনজন মটরসাইকেলে আরোহী।
এখন পর্যন্ত যত জেলায় কাজ করেছি, পাবনার সাংবাদিকদের সবচেয়ে প্রফেশনাল মনে হয়েছে, এখানে অনেক প্রবীন শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক যেমন আছেন তেমনি আছেন শিক্ষিত নবীন সাংবাদিকগন।
পাবনার সবচেয়ে ভাললাগার জায়গা কোনটি বললে বলতে হবে, কাজের প্রয়োজনে সবচেয়ে বেশী যেতে হয়েছে রুপপুর, ঈশ্বরদীতে, নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যানটের যে কর্মযজ্ঞ তা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবেনা, তবে আমার সবচেয়ে পছন্দর জায়গা পাবনার ডাউনটাউন , সিটি সেন্টার বলতে যা বোঝায় সেই হামিদ রোড। এর কারন হয়ত সেখানকার আলো ঝলমলে রুপ ঢাকার কথা মনে করিয়ে দেয়, তবে সেটাই একমাত্র কারন নয়।
হামিদ সড়ক চিনতেই আমার মাস খানেক লেগেছিল, চলতি পথে গাড়ীর কালো কাচের জানালা দিয়ে শহরটা ঠিক বোঝা যায়না, অল্প কয়দিনে, আস্তে আস্তে যখন যাতায়াত বাড়ল তখন চিনলাম। আমার অফিস থেকে এগুলেই বানীবিনা, ইন্দোরা মোড় ছাড়িয়ে হাতের বামে ঢুকলেই সন্ধ্যায় কাবারের ধোয়া ওঠা ঘ্রান, ক্লাসিক কোন ছবির মত চেহারা নিয়ে দাড়িয়ে থাকা জলযোগ রেস্টুরেন্ট, তারপর হাতের ডানে রুপকথা সিনেমা হলের বিপরীতে রুপকথার কাব্যর দরজা খুলে ঢুকতেই ঠিক ঢাকা শহরে গ্লোরিয়া জিনসে পাওয়া কফির ঘ্রান যে পাবনাতে পাওয়া যাবে তা অবিশ্বাস্য, আবার ঘুরে সামনে এগিয়ে গেলে ২৪ ঘন্টা ভীড় লেগে থাকা প্যারডাইস মিস্টির দোকান, আরো এগিয়ে গেলে শ্যামল দই ভান্ডারের সাথে বিদ্যুতের তারে ঝুলতে থাকা হাজার হাজার চড়ুই পাখির দৃশ্য দেশের আর কোন জেলায় আছে কিনা আমার জানা নেই, হামিদ রোডের শেষ মাথায় জেবির মোড়, যেখানে অটো , রিকসা ওয়ালারা সারাক্ষণ থাকেই, আর ঐ এলাকায় ট্রাফিক চেকপোস্ট করতে আমি যে কতদিন রাস্তায় দাড়িয়ে থেকছি কার হিসাব নেই, পুরো হামিদ রোডটা অল্প একটু জায়গা, সরু, পার্কিং না থাকায় রাস্তার একপাশে মাটরসাইকেল আর প্রাইভেট কারের দখলে সারাক্ষণ যানজট লেগে থাকে, তবুও জায়গাটা আমার কেন জানি ভাল লাগে, হয়ত ব্যস্তকার কারনেই এখানে প্রানের স্পন্দন, জীবনের কোলাহল বেশী, কালারফুল এন্ড ফুল অব ভাইব।
পাবনার আর কি ভাল লাগে? মিস্টির জন্য পাবনা বিখ্যাত , আমি নিজে মিস্টি একেবারেই খাইনা, তবে এখানকার ডেইরী শিল্পের কারণে দারুন সব মিস্টি তৈরী হয়, আমার কাছে মিস্টি পছন্দ না হলেও ভাল লাগে পাবনার ভাষা, বেশ মিস্টি, কথার শেষে কেমন একটা টান, আবার সহজবোধ্য। শিক্ষা, শিল্প ও সংস্কৃতিতে পাবনার যে ঐতিহ্য সে কারনেই হয়ত এখানে উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা (পুলিশের এত সিনিয়র অফিসার আমি কোথায়ও পাইনি), ঝানু রাজনীতিবিদ, বিশিষ্ট ব্যবসায়ীরা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছেন, সফল হয়েছেন স্ব স্ব ক্ষেত্রে। আজ পাবনার জন্মদিনে একটা কথা যেটা আমি প্রায়শই বিভিন্ন বক্তব্যে বলি আমরা যারা বাইরে থেকে আসি, যখন যেখানে থাকি সে জেলার প্রতি ভালবাসা থাকে, চেষ্টা করি সরকারী দায়িত্ব পালন করতে, নিজ জেলাকে গড়তে স্থানীয়দের অবদানই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পাবনার জন্মদিনে জেলার সকল নাগরিককে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন।
লেখক : মোহাম্মদ মহিবুল ইসলাম খান, পুলিশ সুপার, পাবনা।