তুহিন হোসেন (ঈশ্বরদী) : সময়ের চক্রক্রমে বছর ঘুরে এসেছে বসন্ত। প্রকৃতিতে তাই লেগেছে রংয়ের ছোঁয়া। দক্ষিণা দারে বইছে ফাগুনের হাওয়া। কোকিলের কণ্ঠে আজ বসন্তের আগমনী স্বর। ফুলে ফুলে ভ্রমর খেলা করছে। গাছে গাছে পলাশ আর শিমুলের মেলা। সব কিছুই জানান দিচ্ছে পহেলা ফাল্গুনের।
ঋতুরাজকে স্বাগত জানাতে প্রকৃতির এতো বর্ণিল সাজ। বসন্তের এই আগমনে প্রকৃতির সাথে তরুণ হৃদয়েও লেগেছে দোলা। শীতকালে ঝরে পড়া পাতার ফাঁকা জায়গা পূরণ করতে গাছে গাছে আবার নতুন পাতা গজায়। গাছগুলো সবুজ পাতায় ছেয়ে যায়, পাতার ফাঁকে বসে কু-হু-কু-হু গান ধরে কালো কোকিল। ফুলে ফুলে ভরে যায় গাছগাছালি। মনের আনন্দে পাখিরা গান গাইতে শুরু করে। লাল ফুল, নীল ফুল, হলুদ ফুল, গোলাপি ফুল, বেগুনি ফুল, আকাশি ফুল, কমলা ফুল, ঘিয়ে ফুল, সাদা ফুল হাজার রঙের ফুল ফোটে বসন্তে !
বসন্ত নিয়ে বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামসহ অনেকেই লিখেছেন গান, কবিতা। দুঃখের বিষয় হলো বর্তমান সময়ে বসন্ত নিয়ে খুব একটা গান-কবিতার পংক্তিমালা রচিত হয়নি রচিত হয়নি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসন্ত নিয়ে অনেক গান-কবিতা লিখেছেন। তার মায়ার খেলা গীতি নাট্যের ‘আহা আজি এই বসন্তে, এতো ফুল ফোঁটে, এতো বাঁশি বাজে এতো পাখি গায়।’
কাজী নজরুল ইসলাম বসন্ত নিয়ে লিখেছেন একটি গানে- ‘বসন্ত আজ আসলো ধরায়, ফুল ফুটেছে বনে বনে, শীতের হাওয়া পালিয়ে বেড়ায় ফালগুণী মোর মন বনে।’ অথবা ‘বসন্ত এলো এলো এলোরে, পঞ্চম স্বরে কোকিল কুহুরে।’
শীত কালকে অনেকে বুড়ির সাথে তুলনা করে বলেছেন, শীতের বুড়ি চলে যাওয়ার পর বসন্তকাল বাংলাদেশের প্রকৃতিতে অপরুপ রমণীয় রূপে আসে। সকল কুসংস্কারকে পেছনে ফেলে, বিভেদ ভুলে, নতুন কিছুর প্রত্যয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার বার্তা নিয়ে বসন্তের উপস্থিতি। তাই কবির ভাষায়-‘ফুল ফুটুক আর না-ই ফুটুক বসন্ত’ আসবেই।
বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তরুণ-তরুণী বসন্ত উম্মাদনায় আজকে মেতে উঠবে। শীতকে বিদায় জানানোর মধ্য দিয়েই বসন্ত বরণে চলবে ধুম আয়োজন। শীত চলে যাবে রিক্ত হস্তে, আর বসন্ত আসবে ফুলের ডালা সাজিয়ে। বাসন্তী ফুলের পরশ আর সৌরভে কেটে যাবে শীতের জরা-জীর্ণতা। বসন্তকে সামনে রেখে গ্রাম বাংলায় মেলা, সার্কাসসহ নানা বাঙালি আয়োজনের সমারোহ থাকবে। ভালোবাসার মানুষেরা মন রাঙাবে বাসন্তি রঙ্গেই। শীতের সঙ্গে তুলনা করে চলে বসন্তকালের পিঠা উৎসবও।
এই ঋতুতে বায়ু নানা দিক থেকে প্রবাহিত হয়, কোন নির্দিষ্ট দিকে স্থির থাকে না। উত্তর-পশ্চিম মৌসুমি বায়ুর প্রবাহের পরিবর্তে গ্রীষ্মের দক্ষিণা অথবা দক্ষিণ-পশ্চিমা বায়ু প্রবাহিত হতে শুরু করার এ ক্রান্তিকালে বায়ুপ্রবাহের দুরন্তপনা শুরু হয়। বসন্তের আবহাওয়া থাকে মনোরম, আকাশে কিছু কিছু মেঘ থাকলেও সার্বিক আবহাওয়া থাকে নির্মল। কদাচিত মার্চের শেষ দিকে দুপুরের পর বিচ্ছিন্নভাবে বজ্রঝড় সংঘটিত হয়ে থাকে।
এ ঋতুতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মনকে প্রকৃতির কাছাকাছি নিয়ে যায়। আত্মভোলা মনে জাগে গান। রক্তবর্ণের শিমুল, পলাশ ও কৃষ্ণচূড়া এ সময়েই ফোটে। আমগাছ সাজে নব মঞ্জরিতে শোভিত হয়ে। ভ্রমর মনের আনন্দে গুঞ্জন করতে করতে সুগন্ধি পুষ্প ও আম্র মঞ্জরির মধু পানে মত্ত হয়। যব, গম, সরিষা ইত্যাদি শস্যে মাঠগুলো রমণীয় শোভা ধারণ করে।
চারদিকে প্রাণের স্পন্দন, সাজ সাজ রব। কংক্রিটের জঙ্গল পাড়ি দিয়ে বসন্তের দখিন হাওয়া উচ্ছ¡াসের রং ছড়িয়েছে রাজধানীবাসীর মনে। প্রতিবছরের মতো এবারো, এসো মিলি প্রাণের উৎসবে’ ¯েøাগান নিয়ে, ফাল্গুনে চারুকলার বকুল তলায় আয়োজন করা হয় বসন্ত বরণ উৎসব।
পলাশ রাঙা সকালে দখিনা হাওয়ায় আমের মুকুলের দোলা জানান দিলো, এসেছে ঋতুরাজ বসন্ত। জীবনের এসেছে পূর্ণতা। নতুন প্রাণের কলরব। চারুকলার বকুলতলায়, তাই বসন্ত বরণের উৎসবে টানে, দালানের খোলস ছেড়ে বাসন্তী সাজে জড়ো হন নগরবাসী। সুরের সম্মোহনে বকুলতলায় মিলে মিশে একাকার প্রকৃতি আর মানুষ।
বাংলাদেশের প্রকৃতি বৈচিত্রময়। প্রতিটি ঋতুতেই এই বৈচিত্র সৌন্দর্য ছড়ায়। তবে বসন্তের সৌন্দর্য উপমাহীন। এর সাথে তুলনা চলে না অন্য কোনো ঋতুর। এমন ফুলেল সময় আর কখনো দেখা যায় না। শীতের জীর্ণতা শেষে প্রকৃতিতে যে উষ্ণতা আসে সেই উষ্ণতায় মানুষের মনও প্রকৃতির সাথে পাল্লা দিয়ে জেগে ওঠে নতুনের আহবানে।
বসন্তের আগমনে বাসন্তি রঙা শাড়ি, কপালে টিপ, হাতে চুড়ি, পায়ে নূপুর, খোঁপায় গাঁদা ফুল জড়িয়ে বেরিয়ে পড়বে তরুণী-বধূরা। বাসন্তি পাঞ্জাবি, ফতুয়া পরা হাজারো ছেলে-বুড়োর ঢল নামবে বসন্ত বরণের নানা আয়োজনে। বসন্তের আমোদনে ফাগুনের ঝিরিঝিরি হাওয়া, রক্তিম পলাশ, শিমুল, কাঞ্চন পারিজাত, মাধবী, গামারী আর মৃদু গাঁদার ছোট ছোট ফুলের বর্ণিল রূপে চোখ জুড়াবে। বসন্ত তারুণ্যেরই ঋতু, তাই সবারই মনে বেজে ওঠে, কবির এ বাণী- ‘বসন্ত ছুঁয়েছে আমাকে। ঘুমন্ত মন তাই জেগেছে, পয়লা ফাল্গুন আনন্দের দিনে’।
নবান্ন উৎসব, পৌষমেলা-এসবের মতো বসন্ত উৎসবও বাঙালি চেতনার অবিচ্ছেদ্য অংশ। যার মাধ্যমে সৃষ্টি হয় পারস্পরিক বিশ্বাস ও সহনশীলতা। দৃঢ়তর হয় মৈত্রীর বন্ধন। শুধু রাজধানীতে নয়, দেশজুড়ে বসন্তের আবাহনে আয়োজন করা হয় নানা অনুষ্ঠান। প্রকৃতি আর মানুষের এই মিলনমেলা গোটা দেশকে মাতিয়ে তোলে আনন্দ হিল্লোলে। ইথারে ইথারে তার রেশ ছড়িয়ে পড়ে বাংলার ঘরে ঘরে।
বাংলাদেশে বঙ্গাব্দ ১৪০১ সাল থেকে প্রথম ‘বসন্ত উৎসব’ উদযাপন করার রীতি চালু হয়। সেই থেকে জাতীয় বসন্ত উৎসব উদযাপন পরিষদ বসন্ত উৎসব আয়োজন করে আসছে। দেশের বিভিন্ন জায়গায় ১লা ফাল্গুন দিনভর উদযাপন করা হয় তরুণ-তরুণীদের বসন্তের উচ্ছ¡াস প্রকাশ। ফোন, ফেসবুক, মিডিয়া, প্রিন্ট মিডিয়া, টুইটারসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলবে শুভেচ্ছা বিনিময়। নানা আয়োজনে বর্ণিল সাজে এদেশের বাঙালিরা বসন্তকে বরণ করে থাকেন।