বৈসাবি উৎসব এখন পাহাড়ি উপজাতীদের সর্বজনীন উৎসব

শেয়ার করুন

। । ড. মো. মনছুর আলম । ।
বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় এবং উৎসবগুলো বিচিত্র রঙে শোভিত। বাংলাদেশের প্রথা ও উৎসবগুলো এসেছে প্রাগৈতিহাসিক স্তর থেকে। বিভিন্ন উপজাতি বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যুগে যুগে এগুলো বহন করে নিয়ে এসেছে। এসব উপজাতি আজও তাদের সংস্কৃতি নিয়ে বসবাস করছে বাংলাদেশের সমতল ভূমিতে এবং পাহাড়-পর্বতে। এদের পূর্বপুরুষেরা ছিল হয় নেগ্রিটো আথবা প্রোটো-অষ্টালয়েড বা প্রোটো-মঙ্গোলয়েড কিংবা ককেশিয়াড। বাংলাদেশে উপজাতি জনগোষ্ঠী দলে দলে আসার পেছনে রয়েছে এদেশের সবুজ শ্যামল প্রাকৃতিক পরিবেশ, নদীবিধৌত ভূমির ঊর্বরতা, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া এবং ধন-সম্পদের দুনিয়াজোড়া খ্যাতি। এসবের আকর্ষণে শুধু আদিবাসী উপজাতিই নয় অনেক আগ্রাসী ভিনদেশী, ব্যবসায়ী ও অন্যান্য ভাগ্যান্বেষীরাও দলে দলে এদেশে এসে এক বহুজাতিক জনগোষ্ঠিতে পরিণত করেছে। এ বহুজাতিক জনগোষ্ঠীর ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, প্রথা, ঐতিহ্য, উৎসবেও রয়েছে ভিন্নতা। আমরা এই বহুজাতিক জনগোষ্ঠীর মধ্য হতে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উৎসব নিয়ে বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামের নৃগোষ্ঠীর ‘বৈশাবি উৎসব’ নিয়ে আলোচনা করবো।
বাংলাদেশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম হলো- চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, মগ, মুরং, বম, খুমি, গারো, হাজং, খাসিয়া, মণিপুরি, মু-া, কোল, ভীল, জুয়াং, কোরওয়া, কোরবু, সাঁওতাল, ওঁরাও, রাখাইন ইত্যাদি। বাংলাদেশের প্রায় সকল নৃগোষ্ঠীর মানুষ নাচ-গান, মদ্যপান ও জলকেলীর মধ্য দিয়ে তাদের আনন্দ-উৎসব পালন করে থাকে। মণিপুরিরা পূজ্য দেবতা রাধাকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে ‘গোপী নাচ’ এবং বসন্তকালে জাঁকজমকের সাথে পালন করে থাকে হোলি উৎসব। ওঁরাওরা ফাল্গুন মাস থেকে বছর গণনা শুরু করে। নববর্ষ বরণ করতে তারা পালন করে ‘ফাগুয়া’ উৎসব। সাঁওতালরা পালন করে সোহরাই, বাহা, পসকা, পরবসহ নানা উৎসব। মারমা ও রাখাইনরা নববর্ষ মহাধুমধামের সাথে পালন করে ‘জল উৎসব’। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর উৎসবে ভিন্নতা থাকলেও পাহাড়ি উপজাতীদের ‘বৈসাবি’ উৎসব আবার ভিন্নমাত্রা যোগ করেছে। ‘বৈসাবি’ উৎসব বর্তমানে পাহাড়ি উপজাতীদের সর্বজনীন উৎসবে পরিণত হয়েছে।
ত্রিপুরাদের বৈসুক উৎসবের ‘বৈ’, মারমাদের সাংগ্রাই উৎসবের ‘সা’ এবং চাকমাদের বিজু উৎসবের ‘বি’ নিয়ে বৈসাবি শব্দের উৎপত্তি। চাকমদের বিজু উৎসব, মারমাদের সাংগ্রাই উৎসব এবং ত্রিপুরাদের বৈসুক উৎসবকে এক মঞ্চে এনে ‘বৈসাবি উৎসব’ বলে আখ্যা দিয়ে এ উৎসবকে সর্বজনীন করা হয়েছে। উপজাতী পাহাড়িদের উৎকৃষ্ট উৎসবগুলোর আদ্যক্ষর নিয়ে বৈসাবি শব্দ তৈরী করে সর্বজনীন রূপ প্রদান করা হয়েছে। ফলে এখন রাঙ্গামাটি, বান্দরবন, খাগড়াছড়ি এ তিন পার্বত্য জেলার অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী এ উৎসবের সাথে একাত্মতা গ্রহণ করতে পেরেছে এবং মহারাম্ভরে ‘বৈসাবি’ উৎসব পালন করতে দেখা যায়।
‘বৈসাবি’ উৎসব মূলত তিনদিন ব্যাপী পালিত হয়। পুরনো বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে বরণ উপলক্ষে পাহাড়ি উপজাতীরা তিনদিন ব্যাপী বর্ষবরণ উৎসব পালন করে থাকে। দীর্ঘকাল ধরে তারা ভিন্ন ভিন্ন নামে পালন করে আসলেও এর সর্বজনীন ব্যবহার ছিল না। বর্তমান সরকার ১২ এপ্রিল সকল স্কুল কলেজ ছুটি ঘোষণা করে এই উৎসবেকে আরো সর্বজনীন করে তুলেছে।
বাংলা নববর্ষ ও চৈত্রসংক্রান্তি উপলক্ষে তিন পার্বত্য জেলায় উপজাতীদের এই ঐতিহ্যবাহী ধর্মীয় ও সামাজিক উৎসব ‘বৈসাবি’ এখন অত্যন্ত আনান্দমুখর পরিবেশে পালিত হতে দেখা যায়। এ উৎসব উপলক্ষে পাহাড়িরা বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিভিন্ন উপজাতী নৃত্য ও গান। এছাড়া থাকে আদিবাসী মেলার আয়োজনও চোখে পড়ার মতো। মেলায় পাহাড়ি কৃষিজাত দ্রব্য, কারূপণ্য, বিভিন্ন প্রকারের হস্তশিল্পজাত সামগ্রী; বিশেষ করে বাঁশ ও বেতের সামগ্রী বেশি পাওয়া যায়। এছাড়া শিশু-কিশোরদের খেলনা, মহিলাদের রান্না-বান্না ও সাজ-সজ্জার সামগ্রীসহ বিভিন্ন লোকোজ খাদ্য ও পানীয় পান থাকে মেলার বিশেষ আকর্ষণ।
নববর্ষের দিন অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল মারমাদের থাকে ঐহিতহ্যবাহী ওয়াটার ফেস্টিবল বা পানি খেলা। পানিকে পবিত্রতার প্রতীক ধরে মারমা উপজাতী তরুণ-তরুণীরা একে অপরকে পানি ছিটিয়ে পবিত্র ও শুদ্ধ হয়। বর্তমানে উপতজাতীদের মাঝে পানি উৎসবটি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
‘বৈসাবি’ উৎসবকে পাহাড়ি উপজাতীরা সাধারণত তিনটি ভাগে ভাগ করে পালন করে থাকে। প্রথম দিন অর্থাৎ ১২ এপ্রিল ‘ফুলবিজু’ উৎসব হিসেবে পালন করে। এ উৎসবে পাহাড়ি শিশু-কিশোররা নানা রকমের ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ১৩ এপ্রিল পালন করে ‘মরুবিজু’ উৎসব হিসেবে। এদিন তারা নানা রকম সবজির সমন্বয়ে এক ধরনের নিরামিষ রান্না করা হয়; যা ‘পাজন’ নামে অভিহিত। এটি বৈসাবি উৎসবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য বা অনুষঙ্গ। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী পিঠা ও মিষ্টান্ন তৈরী করা হয়। অতিথিদের জন্য এদিন সবার ঘর খোলা থাকে। তৃতীয় দিন অর্থাৎ ১৪ এপ্রিল নববর্ষ পালন; অর্থাৎ বাংলার আপামোর জনসাধরণের মত বৈশিাখি উৎসব পালন। এভাবে বাংলাদেশের সকল পাহাড়ি উপজাতীরা ‘বৈসাবি’ উৎসব নামে নতুন আঙ্গিকে উৎসব পালনের মধ্যদিয়ে এবং বাংলাদেশ সরকার উৎসবের সাথে একত্মতা ঘোষণার মধ্যদিয়ে এটিকে একটি সর্বজনীন উৎসবের রূপ দান করতে পেরেছে বলে মনে হয়। এছাড়া প্রতি বছর পাহাড়িদের সাথে আনন্দ ভাগাভাগী করতে সমতল থেকে হাজার হাজার মানুষ যোগ দিচ্ছে এই উৎসবে। ফলে ‘বৈসাবি’ উৎসব সর্বজনীন উৎসবের রূপ পরিগ্রহ করছে। ‘বৈসাবি’ উৎসব পার্বত্য চট্টগ্রামে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যেমন মজবুত করবে তেমনি দৃঢ় হবে পাহাড়ি-সমতল সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন। [ লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।]


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *