।। মো. আসিফুর রহমান ।।
“একটি জাতিকে যথাযথভাবে ধ্বংস করার উপায় হল, জাতিটির ইতিহাসকে অস্বীকার করা ও মানুষের মাঝে বিকৃত করা।“—জর্জ অরওয়েল। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে আমরা যতই নিজেদেরকে স্বাধীন দাবি করি না কেন, আমাদের নিজ ভূমিতে অবস্থানকারী কতিপয় মানুষের কাছে সেই স্বাধীনতা সের দরে বিক্রি করে দেওয়া কোনো বিষয় ই ছিল না। হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে নয় মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধের পর পৃথিবীর মানচিত্রে একটি স্বাধীন দেশের উত্থান স্বাধীনতা বিরোধী পাকিস্তান ও তার তৎকালীন সমর্থকেরা মোটেও গ্রাস করতে পারে নি, যাদের এজেন্টরা আমাদের জাতির ভবিষ্যৎ বিক্রি করে দিতে আজও ইতিহাস বিকৃতির প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি ‘৫২র ভাষা আন্দোলন, ‘৬৯ এর গণঅভ্যুত্থান, ‘৭০ এর নির্বাচন, মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী বাংলাদেশের ইতিহাসের Key event যেগুলোর প্রত্যেকটির নেতৃত্বে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭০ সালে তৎকালীন পাকিস্তানে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জয়ী হয় বিপুল সংখ্যক ভোটে, এবং এটি সাক্ষী বহন করে বাংলাদেশের স্বাধীনচেতা জনগণের মুক্তির প্রয়াস এবং আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাঙালির ভালোবাসার। স্বয়ং ইতিহাস স্বাক্ষী এ জয়ের পরবর্তী ঘটনাচক্রের যা বাংলার আপামর জনগণকে নিজেদের মুক্তির জন্য যুদ্ধে নামতে অণুপ্রাণিত করে, আর এ যুদ্ধের আহবান দিয়ে সমগ্র জাতিকে এক করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে, ৭ই মার্চ, ১৯৭১। ফলশ্রুতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারাবন্দি হন এবং বাঙালির স্বাধীনতার জন্য তিনি দীর্ঘ নয় মাস কারাগারে বন্দি থাকেন। এর মধ্যে বন্দুকের সম্মুখীন হয়ে দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মসমর্পণ করার জন্য পাকিস্তান সরকার নির্দেশ দিতে বলললেও সেই লৌহমানব অনড় থেকেছেন জীবনের হুমকির মুখে, যা বললে নিমিষেই বাংলাদেশকে পরাজয় বরণ করতে হতো। ইতিহাস সাক্ষী সেই লৌহমানবের দৃঢ়তার।
বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং একটি অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত দেশের দায়ভার তাঁর উপর অর্পিত হয়। বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রনীতির মূল লক্ষ্য ছিল দ্রুত আর্থ-সামাজিক পুনর্গঠনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বৈদেশিক সাহায্য, ঋণ, খাদ্যশস্য ও কারিগরি সহযোগিতা নিশ্চিত করা। অন্যদিকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের স্বীকৃতি আদায় করাও ছিল বঙ্গবন্ধু সরকারের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম লক্ষ্য। ১৯৭২ সালের ১৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন, “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়— এমন নীতির দ্বারা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হবে।“ বাহাত্তরের সংবিধানে বলা হয়েছিল, “বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তির ব্যবহার থেকে নিরস্ত্র থাকবে এবং পরিপূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের জন্য সচেষ্ট হবে।“ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কুটনৈতিক দূরদর্শীতার কারণে বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করতে থাকে এবং বৈদেশিক সহায়তা ও দেশীয় শিল্প ব্যবস্থার উন্নয়নের মাধ্যমে একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক অগ্রগতি ত্বরান্বিত হয়।
১৫ই আগস্ট, ১৯৭৫, বাঙালি জাতির ইতিহাসের কালো অধ্যায়। ক্ষমতালোভী বিশ্বাসঘাতক খন্দকার মোশতাক, মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে নীল নকশা করে বাঙালি জাতির জনক, স্বাধীনতার স্থপতি, আপামর জনগণের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ তারিখে সেনাবাহিনীর কতিপয় দেশদ্রোহী সিপাহী (সৈয়দ ফারুক আহমেদ, নূর চৌধুরী, ডালিম, বজলুল হুদা, রশিদ) মেজর মহিউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাসভবনে তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে। তাদের এই নৃশংস ও ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর স্নেহের সর্বকনিষ্ঠ, নিষ্পাপ শিশুপুত্র রাসেলও। হত্যা করা হয়েছিল শেখ ফজলুল হক মনিকে ও তাঁর পরিবারকে, তাঁর নিজ বাসভবনে। গ্রেফতার করা হয়েছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার জাতীয় চার নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমেদ, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামান হেনাকে। খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমানের এই নীল নকশা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ওপর তপ্ত, গলিত লোহা ঢেলে পুড়িয়ে দেওয়ার চেয়ে কোনো অংশে ভিন্ন নয়।
১৫ই আগস্ট, সেনাবাহিনীর ন্যাক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের মধ্যে একজন সাহসী সৈন্যের কথন না বললেই নয়। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শহীদ জামিল উদ্দিন আহমেদ ( বীর উত্তম), যার বীরত্বগাঁথা খুব বেশি মানুষের স্মরণে না থাকলেও, আমার ব্যক্তিগতভাবে তাঁর সততা এবং দেশ, স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতি আনুগত্য হয়তোবা বিশ্বাসঘাতকার সেই মঞ্চে, সূর্যের চাইতেও অধিক উজ্জ্বল মনে হয়। তিনি একমাত্র ব্যক্তি যিনি বঙ্গবন্ধুর ডাক পাওয়া মাত্রই তাঁর সহোচর নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সুরক্ষা দিতে প্রস্তুত হন। কিন্তু যখন কেউ তাঁর ডাকে সারা দেয়নি, তখন একাই ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দিকে ছুটে যান এবং সিপাহীদের হাতে খুন হন রাজধানীর সোবহানবাগ এলাকায়। যেকোনো ইতিহাসে এমন সততা ও সাহসীকতা বিরল।
১৫ই আগস্টের কালো অধ্যায়ের পর শকুনেরা একের পর এক হানা দিতে থাকে। খন্দকার মোশতাক, মেজর জিয়াউর রহমান ক্ষমতার লোভে নিজেদের আত্মা বিক্রি করে তারা একের পর এক ষড়যন্ত্র করতে থাকে এবং নিজেদের ষড়যন্ত্রের শিকার নিজেরাই হতে থাকে। বাংলাদেশের ভীত ও ভবিষ্যৎ ধ্বংস করতে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকরা আরেকটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করে। ৩রা নভেম্বর কারাহত্যা । জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে তারা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন সমুলে উৎপাটন করার উদ্দেশ্যেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটায়।
খন্দকার মোশতাক আহমেদ ক্ষমতা দখল করে নিজেকে রাষ্ট্রপতি হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং সেনাপ্রধান হিসেবে মেজর জিয়াউর রহমানকে নিযুক্ত করে। অতঃপর ক্ষমতা দখল পরবর্তী ঘটনাচক্রের বিবেচনাই নির্ধারণ করা সহজ করে দেয় স্বাধীনতা পক্ষ ও বিপক্ষ শক্তি কি এবং দুয়ের মধ্যে তফাৎ। মোশতাক সরকার গঠনের পরবর্তী সময়েই তৎক্ষণাৎ মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধী, পাকিস্তানের ভ্রাতৃপ্রতিম রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, যা স্পষ্টত প্রমাণ করে, মোশতাক-জিয়া নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ তাদের কাছে পাকিস্তানের সমতুল্য। বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারকে হত্যা করার মনস্তত্ত্ব বিচার করতে প্রয়াত সংসদ সদস্য মঈন উদ্দিন খান বাদলের একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ্য, “আমি ধরে নিলাম ব্যক্তি শেখ মুজিব খারাপ লোক এজন্য তাকে হত্যা করছেন। কিন্ত আপনি যখন তাকে নির্বংশ করতে চাচ্ছেন সেখানে একটা সিগনেচার আছে। হত্যাকারী আর হত্যার শিকার কখনো এক রাস্তায় হাঁটে না।“ পাপ কখনও পাপীর পিছু ছাড়ে না। এবং পাপের ফল থেকে পালানোর জন্য ভীরু মানুষ যা করে, তা নিঃসন্দেহে আরেকটি মহাপাপ।
ধরুন আপনাকে একটি দৃশ্যপটের মধ্যে ফেলা হলো, যেখানে আপনার পুরো পরিবারকে কেউ অন্যায়ভাবে হত্যা করল, কাউকে ছাড়লো না। এবং সেই হত্যাকাণ্ডের পর ঘাতক বুক উঁচিয়ে সমাজের মাঝে ঘুরছে, যেখানে সে আইনের বহু উর্ধ্বে। বছরের পর বছর এভাবে চলে যায় কোন বিচার ছাড়া এবং এসব কিছু আপনার চোখের সামনেই হয়। এমন পটভূমিতে দীর্ঘ এই সময়কালে আপনার মানসিক চিন্তা-চেতনা, জীবনের লক্ষ্য কি বস্তুকেন্দ্রিক থাকবে? মানুষ হিসেবে আমরা সবাই জীবনের কোনো না কোনো ঘটনা দ্বারা পরিচালিত হই, তবে এমন ঘটনা নিঃসন্দেহে খুব কম মানুষের সাথেই ঘটেছে। এবং যারা এমন অগ্নিজালে দগ্ধ হয়ে পায়ের পর পা ফেলে এগিয়ে যায়, তাঁদের লক্ষ্য মোটেও বস্তুকেন্দ্রিক হবে না। জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপের হিসাব হবে ন্যায়ের মাপকাঠি দিয়ে, অন্যায় যেখানে তাঁর চিরশত্রু। এমনি অগ্নিঝড়ের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয়েছেন আমাদের দেশরত্ন। ইতিহাস সাক্ষী সেই অগ্নিঝড়ের, বছরের পর বছরের অত্যাচার, অন্যায়, হত্যাচেষ্টার। যেখানে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন ছিল একটি আলোকিত, উন্নত ও গর্বিত বাংলাদেশ, সেখানে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন পূরণের প্রতিটি পদক্ষেপই শত্রুর মুখে চপেটাঘাত। সেই উন্নত বাংলাদেশেরই স্বপ্ন দেখেন জননেত্রী শেখ হাসিনা, এর চাইতে সত্য অন্য কিছু হতে পারে না, যা অস্বীকারকারী হয় বিবেকহীন, নতুবা মনুষ্যত্বহীন।
দেশরত্ন শেখ হাসিনা নিজ দেশে ফেরার পর, জনগণ তাঁকে আপন মনে করে বরণ করেছিল, কিন্তু ক্ষমতাপিপাসু অত্যাচারী বিএনপি সরকার একজন নিরপরাধ, শোকসন্তপ্ত কন্যাকে অত্যাচারে কোনো ত্রুটি রাখেনি। ২১শে আগস্ট, ২০০৪ সালের গ্রেনেড হামলা আরেকটি সাক্ষ্য বহন করে, তৎকালীন বিএনপি সরকারের সন্ত্রাসী পৃষ্ঠপোষকতার ও ষড়যন্ত্রের। রমনা বটমূলের মাটিতে রক্তের দাগ ও ছিটিয়ে থাকা স্যান্ডেল সাক্ষ্য বহন করে, বাংলাদেশে এখনও পাকিস্তানের শোষকদের চরিতার্থ এক গোষ্ঠী অনুসরণ করে। তবে জনগণের নিরঙ্কুশ ভালোবাসা ও সমর্থন জননেত্রী শেখ হাসিনাকে রক্ষা করেছে এবং তারই ফলশ্রুতিতে বর্তমানে আজ আমরা একটি গর্বিত উন্নয়নশীল বাংলাদেশে বাস করছি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, যাঁর ডাকে বাঙালি নয় মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করে, যাঁকে বাংলাদেশের মানুষ কারামুক্তির পর দেশ পুনর্গঠনের দায়িত্ব দেয়, যাঁর স্বপ্নে উন্নত বাংলাদেশের মানচিত্র মানুষ দেখেছে। বঙ্গবন্ধু মানেই স্বাধীনতা, স্বাধীনতা মানেই বঙ্গবন্ধু। আর স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি বঙ্গবন্ধুর রক্ত দেশরত্ন জননেত্রী শেখ হাসিনা এবং বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আওয়ামী লীগ সরকারের হাতেই পূর্ণতা পায় এবং তারই সাথে এগিয়ে চলে দুর্বার গতিতে। ষড়যন্ত্রকারী এখনও বাংলাদেশের ইতিহাস অস্বীকার করে বিকৃত করার চেষ্টা চালায়, কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাস দিনের আলোর মতো স্পষ্ট, যা কখনই মুছে যাওয়ার নয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের পর বাংলাদেশের মানুষ সেই কালো দিনগুলো ভুলেনি, যার কারণে আজ ৪৬ বছর পরও মানুষ স্মরণ করে সেই কালো দিনকে, যেই কালো দিন সত্য এবং অসত্যকে পরিষ্কার করে আলাদা করে রাখে। বাঙালি বীরের জাতি, আমরাই শোষকদের কাছ থেকে ক্ষমতা সত্যের কাছে স্থানান্তর করি। আজ যতদিন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে থাকবে দেশ, ততদিন পথ হারাবে না বাংলাদেশ।
লেখক : শিক্ষার্থী মো. আসিফুর রহমান, (এমবিবিএস, শেষ বর্ষ),
পাবনা মেডিকেল কলেজ।