॥ বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.স.ম আব্দুর রহিম পাকন ॥
২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট দিনটি বাঙালি জাতির জীবনে আর একটি কলঙ্কময় অধ্যায় রচিত হয়। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর আজীবন সহপাঠী শহীদ বেগম ফজিলাতুন্নেছা সহ তাঁর পরিবারের সকল সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে জাতির পিতার দুই মেয়ে দেশে না থাকার কারণে প্রাণে বেঁচে যান। ১৯৮১ সালের ১৭ই মে দীর্ঘ ৬ বছর নির্বাসিত জীবন যাপন শেষে শেখ হাসিনা স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করেন এবং বঙ্গবন্ধু নিজ হাতে গড়া বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সভানেত্রী হিসাবে দায়িত্ব প্রাপ্ত হন। তাঁর প্রত্যাবর্তনে বাংলার মানুষ সেদিন ছিল উদ্বেলিত। বাংলার মানুষ যেমনি উদ্বেলিত হয়েছিল ১৮৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে কাছে পেয়ে।
জননেত্রী শেখ হাসিনা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু’র মতই ঢাকা বিমানবন্দর থেকে সরাসরি রেসকোর্স ময়দানে লাখো লাখো জনতার সম্মুখে হাজির হয়ে পিতা মাতা, ভাই সকল স্বজন হারানোর বেদনায় কান্নায় ভেঙে পড়েন এমনকি সভামঞ্চে বারবার জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতেও তিনি দীপ্ত কন্ঠে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষ্যে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধু’র আদলে আওয়ামীলীগকে সংগঠিত করবার লক্ষে সারাদেশে এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে মানুষের ভালোবাসা কুড়ানোর লক্ষে জনসভা ও কর্মীসভার কাজ শুরু করেন। তাঁর এই সফরে তৎকালীন সরকার সহ জঙ্গিবাদ পুষ্ট সকল সংগঠন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং তাঁকে বারবার হত্যার প্রচেষ্টা চালায়। জননেত্রী শেখ হাসিনা মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেও ছিলেন অবিচল।
তাঁর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং বাংলার মানুষের ভালোবাসা নিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ১৯৯৬ সালে সরকার গঠন করে এবং ২০০১ সালে ষড়যন্ত্রের নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামীলীগ আবার ক্ষমতাচ্যুত হয়। জননেত্রী শেখ হাসিনা এই নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিয়ে তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করেন এবং দলকে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে আবারো পদচারণা শুরু করেন। এতে বিএনপি তথা জঙ্গিবাদের মদদপুষ্ট সংগঠন গুলি ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁকে আবারো হত্যার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়।
২০০৪ সালের ২১ শে আগস্ট দেশব্যাপী জঙ্গিদের বোমা হামলা ও পুলিশি হামলার প্রতিবাদে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। তারই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, ঢাকা মহানগর শাখা ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের মহানগর আওয়ামীলীগের কার্যালয় সম্মুখে এক প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করেন। এই প্রতিবাদ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগের সভানেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা।
বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মি নিয়ে শান্তিপূর্ণ ভাবে সমাবেশের কার্যক্রম যথাসময়ে শুরু হয়। জননেত্রী শেখ হাসিনা বিকেল ৫ টার দিকে আসেন এবং ট্রাকের উপর নির্মিত মঞ্চে প্রায় ১৫ থেকে ২০ মিনিট বক্তব্য প্রদান করেন এবং বক্তব্য শেষে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ মিছিলের ঘোষণা দিয়ে মঞ্চ থেকে নিচে নেমে আসার মুহূর্তে তাঁকে লক্ষ্য করে প্রায় ১৩টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করা হয়। এই গ্রেনেড হামলার সঙ্গে সঙ্গে সমাবেশে উপস্থিত লক্ষ লক্ষ জনতা প্রাণ বাঁচানোর জন্য চারিদিকে ছোটাছুটি শুরু করেন। মঞ্চে উপবিষ্ট নেতৃবৃন্দ ও কর্মীবৃন্দ জননেত্রী শেখ হাসিনাকে এক মানব প্রাচীর তৈরি মাধ্যমে তাঁর জীবন রক্ষা করেন।
এই গ্রেনেড হামলায় ঘটনাস্থলে আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নারীনেত্রী সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমানের সহধর্মিনী আইভি রহমান সহ ২৪ জন ঘটনাস্থলে শাহাদাত বরণ করেন এবং শীর্ষ নেতৃবৃন্দ সহ প্রায় ৩০০ শত নেতাকর্মী আহত হন। আহত জননেত্রী শেখ হাসিনাকে নেতৃবৃন্দ ও কর্মীবৃন্দ মানব প্রাচীর এর মাধ্যমে তাঁর গাড়িতে তুলে দেন কিন্তু উৎপেতে থাকা হামলাকারীরা জননেত্রীকে হত্যার লক্ষে তাঁর গাড়িকে লক্ষ্য করে গুলি চালাতেও দ্বিধাবোধ করে নাই। জননেত্রী পরিস্থিতি উপলব্ধি করে সরাসরি তাঁর নিজ বাসভবনের উদ্দেশ্যে রওনা না দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একজন অধ্যাপকের বাসভবনে আশ্রয় নেন। সেখান থেকে ঢাকা মহানগর আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যোগাযোগ করলে নেতৃবৃন্দ তাঁকে পাহারা দিয়ে তাঁর নিজ বাসভবন ধানমন্ডিতে নিয়ে যান।
হামলাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল জননেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করে জাতির পিতার পরিবারকে নির্বংশ করা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে চিরতরে ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা।
এই গ্রেনেড হামলার মূল পরিকল্পনা করা হয়েছিল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বড় ছেলে তারেক রহমানের নিজস্ব কার্যালয় হাওয়া ভবন থেকে।
তারেক রহমানের নেতৃত্বে লুৎফুজ্জামান বাবর, আব্দুস সালাম পিন্টু, আলী আহসান মোহাম্মদ মোজাহিদ, মুফতি হান্নান, হারিছ চৌধুরী সহ বিএনপি ও জঙ্গীসংগঠনের আরও অনেকে এই বোমা হামলার মুল পরিকল্পনাকারী ছিল। এই হামলার সকল দন্ডপ্রাপ্তদের মহামান্য আদালত কর্তৃক রায় দ্রুত কার্যকর করার জন্য সরকারে নিকট জোর দাবি জনাই।
লেখক : বীর মুক্তিযোদ্ধা আ.স.ম আব্দুর রহিম পাকন
সাবেক উপদেষ্টা, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ পাবনা জেলা শাখা, কেন্দ্রীয় নির্বাহী সদস্য সেক্টর কমান্ডারস্ ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ’৭১, সভাপতি বঙ্গবন্ধু ফাউন্ডেশন পাবনা জেলা শাখা, সাবেক কর্মকর্তা, আন্তর্জাতিক পারমাণুবিক শক্তি সংস্থা এবং সাবেক সাধারণ সম্পাদক (১৯৭৩-৭৫), পাবনা জেলা ছাত্রলীগ।