হিজরি সালের প্রাক-কথন

শেয়ার করুন

॥ ড. মো. মনছুর আলম ॥
হিজরি নববর্ষ ১৪৪৫-এর শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। বাংলাদেশের মানুষের কাছে বঙ্গাব্দ, খ্রিস্টাব্দ ও হিজরি সালের গুরুত্ব অনেক। তাই হিজরি সাল নিয়ে আলোচনার দাবি রাখে। যুগে যুগে মানুষ তার জীবনের স্মৃতিময় দিনগুলোকে স্মৃতি হিসেবে লালন এবং দৈনন্দিন জীবন সঠিকভাবে পালনের জন্য দিন, মাস ও সাল গণনার প্রয়োজন অনুভব করে আসছে। এই প্রয়োজনের তাগিদে চন্দ্র ও সূর্যকে অবলম্বন করে বর্ষপঞ্জি আবিষ্কার করেন। পৃথিবীতে সর্বপ্রথম প্রাচীন মিশরীয়গণ ২৭৭৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ৩৬৫ দিনের এক সৌর বর্ষপঞ্জি প্রণয়ন করেন। এরপর অ-সেমেটিক সুমেরীয়গণ চন্দ্র পঞ্জিকার আবিষ্কার করেন। এবার আসা যাক হিজরি সালের আলোচনায়।
আরবের আদিম অধিবাসী সেমেটিক জাতি হিসেবে পরিচিত। এই সেমেটিক জাতির একটি শাখা টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরে ব্যাবিলনীয় সভ্যতা গড়ে তোলেন। এরাও চন্দ্র মাস গণনার কৃতিত্ব দেখান। তারা বারো মাসে বছর, চার সাপ্তাহে মাস, বারো ঘণ্টায় দিন এবং ষাট মিনিটে ঘণ্টা গণনা করে এক নতুন দিগন্তের উম্মোচন করেন। সেমেটিক জাতির অপর শাখাগুলো অ্যাসিরীয়, ফিনিশীয় ও হিব্রু সভ্যতা গড়ে তোলেন। আর মূল সেমেটিকরা আরবেই থেকে যান। ইতিহাসবিদগণ স্বকীয়তা এবং স্বাতন্ত্র্যবোধে উদ্দীপ্ত আরব সেমেটিক জাতিকে দু‘ভাগে বিভক্ত করেছেন যথা- বায়দা ও বাকিয়া। কুরআন শরিফে বর্ণিত প্রখ্যাত প্রাচীন বংশ ‘আদ’, ‘সামুদ’, ‘তামস’ ও ‘জাদিস’ প্রভৃতি বায়দা শ্রেণিভুক্ত। পরবর্তীকালে বাকিয়া জাতির অভ্যুত্থানে বায়দা গোত্রগুলোর বিলুপ্তি ঘটে। বর্বমানে এই বাকিয়া জাতি আরব ভূখ-ের প্রধান অধিবাসী। এ বাকিয়ারা আবার দু’ভাগে বিভক্ত যথা- প্রকৃত আরব বা আরিবা (Arabian Arabs) ও আরবিকৃত আরব বা মুস্তারিবা (Arabicized Arabs)। সর্বাপেক্ষা আদিম ও নিষ্কলুস রক্তের অধিকারী আরিবা গোত্র কাহতানের বংশসম্ভূত। কাহতান বংশের অভ্যূত্থান হতেই আরব জাতির প্রকৃত ইতিহাসের সূত্রপাত হয়। মূলত এরা দক্ষিণ আরবে বসবাস করত এবং হিমারীয় নামে পরিচিত। হযরত ইসমাইলের একজন বংশধর আদনান মুস্তারিবা গোত্রের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। হেজাজ, নজদ, পেট্টা, পালমিরা অঞ্চলে বসবাসকারী এ মুস্তারিবা গোত্রের নিযারি (Nizari) শাখা হতে হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কুরাইশ বংশের উদ্ভব হয়। এরা উত্তর অরবের হেজাজের অধিবাসী হিসেবে হেজাজি বা মুদারি নামেই সমধিক পরিচিত। জাতি, কৃষ্টি, ভাষাগত পার্থক্যও ছিল এই দুই আরবের মধ্যে। বিধায় উত্তর ও দক্ষিণ আরবের মধ্যে সব সময় অন্তর্দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষ লেগে থাকত। উত্তর আরবের লোকেরা সাধারণত যাযাবর জীবনযাপন করত পক্ষান্তরে দক্ষিণ আরবের লোকেরা নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত ছিল। উত্তর আরবের লোকেরা আরবিতে কথা বলত অপরদিকে দক্ষিণ আরবের লোকেরা প্রাচীন সেমেটিক ভাষা, সাবেয়ি ও হিমারীয় ভাষা ব্যবহার করত। উত্তর-দক্ষিণ আরব দ্বন্দ্ব থাকলেও আরব সেমেটিক জাতিই চন্দ্র মাস আবিষ্কার করেন। তারা শুধু বারো মাসে বছর গণনা করে চলতেন। হযরত ওমর (রা.) আমল পর্যন্ত আররেবা সাধারণত এভাবেই চলে আসছিল। তাদের স্মরণশক্তি তিক্ষè হওয়ায় তারা লিখিত কোন পঞ্জিকা তৈরী করেন নি। হিজরি সাল প্রবর্তনের পূর্বে তারা বিভিন্ন স্মরণীয় ঘটনার ওপর নির্ভর করে দিন গণনা করতেন এবং আরবি মাসসমূহ ব্যবহার করতেন। যেমন তারা ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে আবরাহা কর্তৃক হস্তি বাহিনী নিয়ে কাবাঘর আক্রমণের বছরকে হস্তির বছর হিসেবে অভিহিত করতেন।
ইসলামের আবির্ভাবের পর বিশেষকরে হযরত ওমর (রা.)-এর আমলে ইসলামের ব্যাপক সম্প্রসারণে একটি নির্দিষ্ট তারিখ হিসেব করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। কারণ একদিন তাঁর নিকট একটি চুক্তিপত্র উত্থাপন করা হলে চুক্তিপত্রে শাবান মাসের কথা উল্লেখ থাকলেও কোন বছরের শাবান মাস তা উল্লেখ ছিল না। তখন ওমর (রা.) বললেন, এটা কী গত শাবান না আগামী শাবান মাস হবে? এ ধরনের বাস্তবতায় তিনি একটি আধুনিক যুগোপযোগী সাল তৈরীর তাগিদ অনুভব করলেন। এ তাড়না থেকে তিনি হযরত আলী (রা.) সহ বিভিন্ন সাহাবিদের নিয়ে একটি পরামর্শ সভা গঠন করেন। সভার কেউ কেউ রাসূল (সা.)-এর জন্মসাল থেকে সাল গণনা করার কথা বলেন, কেউ আবার মোহাম্মদ (সা.)-এর ওপর ওহি আসার দিন থেকে, কেউ তাঁর ইন্তিকাল থেকে সাল গণনার অভিমত ব্যক্ত করেন। কিন্তু হযরত ওমর (রা.) রাসূল (সা.)-এর হিজরতের সাল থেকে সাল গণনার প্রস্তাব করেন এবং যুক্তি হিসেবে বলেন- হিজরত ছিল সত্য ও মিথ্যার মাঝে পার্থক্যকারী ঘটনা; এতে সকল সাহাবিগণ একমত পোষণ করেন।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) ৬২২ খ্রিস্টাব্দের ২ জুলাই মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। রাসূল (সা.)-এর হিজরতের সালকে অর্থৎ ৬২২ খ্রিস্টাব্দেব ২ জুলাই তারিখকে মুহররম মাসের শুক্রবার হিসেব ধরে এবং ১২ মাসে বছর ধরে হিজরি সাল গণনা শুরু করেন। এই হিজরি সালের প্রথম প্রয়োগ ঘটে হযরত ওমর (রা.)-এর শাসনামলে ৩০ জমাদিউস সানি, ১৭ হিজরি অর্থাৎ ৬৩৮ খ্রিস্টাব্দের ১২ জুলাই থেকে। এভাবে হিজরি সাল আজ পর্যন্ত চলে আসছে এবং মুসলিম ঐতিহ্য লালন করে এগিয়ে চলেছে।
রাসূল (সা.) যখন হিজরত করেন তখন আরবের মাস ছিল রবিউল আউয়াল মাস। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে ওমর (রা.) কেন মুহররম মাসকে হিজরি প্রথম মাস নির্ধারণ করলেন। উত্তর হচ্ছে- পবিত্র কুরআনে এরশাদ হচ্ছে, “নিশ্চয়ই আল্লাহ বিধান ও গণনার মাস বারোটি, আসমানসমূহ ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকে। তন্ম্েেধ্য চারটি মাস সম্মানিত এটিই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান।” (সুরা তাওবা : আয়াত-৩৬)। এ আয়াতের চারটি সম্মানিত মাসকে চিহ্নিত করতে গিয়ে রাসূল (সা.) বিদায় হজ্বের ভাষণে স্পষ্ট উল্লেখ করেন এবং বলেন- যিলকদ, যিলহজ্ব, মুহররম ও রজব মাস এই চারটি সম্মানিত মাস। হযরত ওমর (রা.) আল-কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী এবং রাসূল (সা.)-এর উল্লেখিত সম্মানিত চারটি মাসের মধ্যে মুহররম মাসকেই প্রথম মাস হিসেবে বেছে নেন। এ আয়াতের দ্বারা প্রমাণিত সত্য যে, আল্লাহর দৃষ্টিতে শরিয়তের আহকামের ক্ষেত্রে চন্দ্র মাসই নির্ভরযোগ্য। তাই সারা বিশ্বের মুসলিম উমাহ্ চন্দ্র মাসের হিসেব মতেই নামজ, রোযা, হজ্ব, যাকাত, কুরবানি, শবেকদর, শবেবরাত, আশুরাসহ ইসলামের বিভিন্ন তাহজিব-তমুদ্দুন পালন করে থাকেন। তবে আল-কুরআন চন্দ্রকে যেমন সাল-তারিখ গণনার মানদ-রূপে অভিহিত করেছেন তেমনি সূর্যকেও করেছেন। সুতরাং চন্দ্র ও সূর্য উভয়টির মাধ্যমেই সাল-তারিখ নির্দিষ্ট করা যাবে, তবে চন্দ্রের হিসাব আল্লাহর নিকট অধিকতর পছন্দনীয়।
হিজরি সালের বারো মাসের নাম- মুহররম, সফর, রবিউল আউয়াল, রবিউস সানি, জমাদিউল আউয়াল, জমাদিউস সানি, রজব, শাবান, রমযান, শাওয়াল, যিলকদ ও যিলহজ। মুহররম : এর অর্থ পবিত্র, সম্মানিত। যেহেতু এটি হারাম মাসের একটি, তাই একে মুহররম হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। সফর : সফর শব্দের অর্থ খালি হওয়া। কেননা, হারাম মাস মুহররমের পরে সবাই ঘর ছেড়ে যুদ্ধে বের হতো, তাই এ মাসকে সফর বা খালি নামে অভিহিত করা হয়েছে। রবিউল আউয়াল ও রবিউস সানি : রবি অর্থ বসন্ত। অ্যারাবিয়ান বসন্তকাল এ দু’মাসে হয় বিধায় রবিউল আউয়ালকে প্রথম বসন্ত এবং রবিউস সানিকে দ্বিতীয় বসন্ত হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। জমাদিউল আউয়াল ও জমাদিউস সানি : ‘জমদ’ অর্থ জমাট বাঁধা। আরবের আবহাওয়া এ দু’মাসে প্রচ- ঠা-া হয়, ফলে বরফ জমাট বাঁধে। তাই এই দুই মাসের নামকরণ জমাদিউল আউয়াল ও জমাদিউস সানি করা হয়েছে। রজব : রজব শব্দের অর্থ সম্মান করা। যেহেতু আরবের জনগণ এ মাসকে সম্মান করে যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে বিরত থাকত, তাই এ মাসের নামকরণ এরূপ হয়েছে। শাবান : এর অর্থ বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভক্ত হওয়া। হারাম মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে বিরত থাকার পর আরবেরা আবার আক্রমণের জন্য বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভিক্ত হয়ে পড়ত বিধায় এ মাসের নাম শাবান রাখা হয়েছে। রমযান : রমযান ‘রমজ’ শব্দ থেকে এসেছে, যার অর্থ দগ্ধ হওয়া। এ মাসে আরবে সাধারণত প্রচ- গরম পড়ত বিধায় এ মাসের নাম রমযান রাখা হয়েছে। শাওয়াল : এর অর্থ কমে যাওয়া। এ সময় আরবদের উটের দুধ বিভিন্ন কারণে কমে যেত, তাই এ মাসের নাম শাওয়াল রাখা হয়েছে। যিলকদ : ‘কাদা’ শব্দের অর্থ বসে থাকা। যেহেতু এ মাস সম্মানিত ও হারাম হওয়ায় আরবেরা যুদ্ধ-বিগ্রহ না করে ঘরে বসে থাকত তাই এ মাসকে যিলকদ নামে অভিহিত করা হয়েছে। যিলহজ¦ : যিলহজ¦ অর্থ হজ¦ওয়ালা। যেহেতু এ মাস ছিল হজে¦র মাস তাই এ মাসকে যিলহজ¦ নামে অভিহিত করা হয়েছে। হিজরি সালের মাসগুলোর নামকরণের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, আরবের আবহাওয়া পরিবেশ-প্রতিবেশের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশের জনগণ সন ব্যবহারের ক্ষেত্রে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে থাকে ‘খ্রিস্টাব্দ’কে। মূলত আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, লেনদেন, ব্যবসায়-বাণিজ্য ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে খ্রিস্টাব্দ বেশি কার্যকর। হিজরি সাল-তারিখ ধর্ম পালনের ক্ষেত্রে সাধারণত ব্যবহার করে থাকে। [ লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক; সভাপতি- সাহিত্য ও বিতর্ক ক্লাব পাবনা। ]


শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *